ফিরে দেখা ২০২০:
মৃত্যু, এটি জীবনচক্রের পরিণতি। আরেকভাবে বললে এটি জীবনের খুব স্বাভাবিক নিয়ম। তবু কিছু কিছু মৃত্যু গভীর বেদনা নিয়ে উপস্থিত হয়। বিশেষ করে যেসব ব্যক্তিত্ব নানাভাবে মানুষকে প্রভাবিত করেন। কাজে, কর্মে। আরো স্পষ্ট করে বললেন, বিনোদন জগতের মানুষেরা সেই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেন গণমানুষকে।
অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় ২০২০ সাল যেন সাংস্কৃতিক ও বিনোদন অঙ্গনের মানুষের জন্য অধিক শোকের। কারণ এই বছর করোনার কারণেও হারাতে হয়েছে বহু গুণী মানুষদের। বছর শেষে ২০২০ সালে থিয়েটার, নাটক ও সিনেমার এমন হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা থাকলো এখানে:
আলী যাকের: দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। সর্বশেষ বার্ধক্য ও হার্টের সমস্যাসহ বেশ কিছু শারীরিক জটিলতা নিয়ে গত ১৭ নভেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
১৯৭২ সালের আরণ্যক নাট্যদলের ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু করেন আলী যাকের। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে যোগ দেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। এখনও সেই নাট্যদলে সঙ্গেই সম্পৃক্ত রয়েছেন। মঞ্চে অভিনয়ের বাইরে তার নাট্য নির্দেশনাও কম নয়। কাজ করেছেন আজ রবিবার, বহুব্রীহি, তথাপির মতো দর্শকপ্রিয় টিভি নাটকেও।
আলাউদ্দিন আলী: বাংলা সংগীতের কিংবদন্তী পুুরুষ আলাউদ্দিন আলী। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত প্রায় চার দশক জুড়ে চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশনে ৫ হাজারেরও বেশি গান তৈরি করেছেন তিনি। অসংখ্য জনপ্রিয় গান আছে আলাউদ্দিন আলীর। বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন এই কিংবদন্তী। আটবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন। দীর্ঘদিন রুগে
আজাদ রহমান: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সুরকার, সংগীত পরিচালক, ও সংগীতশিল্পী ছিলেন আজাদ রহমান। কিংবদন্তী এই সংগীতজ্ঞের প্রয়াণ ঘটে চলতি বছরের ১৬ মে। দীর্ঘদিন ধরেই হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে বাংলা খেয়ালের জনক বলা হয় তাঁকে। তাঁর উদ্যোগ আর আয়োজনেই প্রতি বছর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে বসে বাংলা খেয়াল উৎসবের। সর্বশেষ গেল ফেব্রুয়ারিতে রাতভর ৭তম বারের মতো এই উৎসব চলে। বাংলা খেয়াল নিয়ে সেসময় আরো বিস্তর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তার সুরকৃত প্রথম চলচ্চিত্র বাবুল চৌধুরীর আগন্তুক। তাঁর সুর ও নিজের কণ্ঠে গাওয়া ‘ভালবাসার মূল্য কত’, ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রের ‘কারো মনে ভক্তি মায়ে’, দস্যু বনহুর চলচ্চিত্রের ‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ গানগুলো সত্তরের দশকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো’-এর মত কালজয়ী দেশাত্মবোধক গানের সুর করেছিলেন।
কে এস ফিরোজ: ছোটপর্দার গুণী অভিনেতা ছিলেন কেএস ফিরোজ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন এই অভিনেতা। তিনি নাট্যদল ‘থিয়েটার’ এর হয়ে অভিনয় শুরু করেন।
সাদেক বাচ্চু: বাংলা চলচ্চিত্রের দাপুটে অভিনেতা ছিলেন সাদেক বাচ্চু। ৬৬ বছর বয়সী এ অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ২০১৩ সালে তার হৃদ্যন্ত্রে অস্ত্রোপচারও করাতে হয়েছিল। সর্বশেষ তার শরীরে করোনা পজিটিভ আসে। ফলে শ্বাস নিতে মারাত্মক সমস্যা হয়। শেষ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ১৪ সেপ্টেম্বর মারা যান এই অভিনেতা।
মান্নান হীরা: ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে হঠাৎ মারা যান নাট্যকার মান্নান হীরা। যে কজন নাট্যকার এ দেশের পথনাটককে সমৃদ্ধ করেছেন, মান্নান হীরা তাদের অন্যতম। তার একাধিক নাটক অনূদিত হয়ে দিল্লি, হংকং, পাকিস্তান, নেপালসহ অনেক দেশে প্রদর্শিত হয়েছে।
আব্দুল কাদের: মঞ্চ, টিভি নাটক ও সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা আবদুল কাদের মারা যান চলতি বছরের ডিসেম্বরের ২৬ তারিখ। ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। তার ক্যারিয়ারে ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বদি চরিত্রটি মাইলফলক হয়ে আছে।
এন্ড্রু কিশোর: দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর চলতি বছরের ৬ জুলাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের কিংবদন্তী শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। গত বছর তার শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামের ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে।
জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, হায়রে মানুষ রঙের ফানুস, ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, আমার বাবার মুখে, আমার সারা দেহ, আমার বুকের মধ্যেখানে, তুমি আমার জীবন, ভেঙ্গেছে পিঞ্জর, ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও, তুমি মোর জীবনের ভাবনা, আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটারে, তোমায় দেখলে মনে হয়, কিছু কিছু মানুষের জীবনে কি যাদু করিলার মতো অসংখ্য বাংলা গান উপহার দিয়েছেন তিনি। গান গেয়ে জীবনে মোট আটবার পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার।
আব্দুস সাত্তার: ‘রঙ্গিন রূপবান’ ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি পাওয়া চিত্রতারকা আব্দুস সাত্তার মারা যান চলতি বছরের ৪ আগস্ট। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। ‘রঙ্গিন রূপবান’ সিনেমায় অভিনয় করে সবার মন জয় করেছিলেন চিত্রনায়ক সাত্তার। ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘মধুমালা মদন কুমার’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘সাগরকন্যা’, ‘শিশমহল’, ‘ঝড় তুফান’, ‘ঘরভাঙ্গা সংসার’, ‘জেলের মেয়ে রোশনী’সহ দেড় শতাধিক দর্শকনন্দিত সিনেমায় অভিনয় করেছেন এই অভিনেতা।
জাহাঙ্গীর খান: চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান দেশের প্রখ্যাত এই প্রযোজক। তিনি ৪৩টি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিলেন। তাকে বলা হতো বাংলাদেশের ‘মুভি মোগল’। আলমগীর পিকচার্সের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতেন তিনি। নয়নমণি, কি যে করি, সীমানা পেরিয়ে, চন্দ্রনাথ ও শুভদা’র মত চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন।
মতিউর রহমান পানু: বাংলাদেশের একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। তিনি ১৯৬৪ সালে প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ‘হারানো মানিক’ ছবিটি পরিচালনা করে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৯০-১৯৯১ সালে ভারতের কলকাতায় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটি নির্মাণ করেন। ২০০২ সালের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘মনের মাঝে তুমি’ অন্যতম সেরা ছবি। ২০০৫ সালে সালাউদ্দিন লাভলু পরিচালিত ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’ ছবিটিও তিনি প্রযোজনা করেন। বার্ধক্যজনিত রোগেই ভুগছিলেন তিনি, চলতি বছরের ২৪ মার্চ মারা যান।
আমিনুল ইসলাম মিন্টু: করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর মারা গেছেন দি রেইন, সারেং বউ, অঙ্গার ও গরীবের বউয়ের মতো দেড় শতাধিক বাংলা ছবির চিত্রসম্পাদক আমিনুল ইসলাম মিন্টু।
ইশরাত নিশাত: চলতি বছরের শুরুতেই মারা গেছেন মঞ্চ অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী ইশরাত নিশাত। তিনি প্রয়াত অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ারের কন্যা। ‘দেশ নাটক’ নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন নিশাত। মঞ্চে একাধারে অভিনেত্রী, নির্দেশক ও আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তাঁর নির্দেশনায় ‘দেশ নাটক’ প্রযোজনা ‘অরক্ষিতা’ প্রশংসিত হয়।
ফেরদৌসী আহমেদ লিনা: ১৯৭৫ সালে একটি তেলের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিনোদন অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন লিনা। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘কালো কোকিলা’ নাটকে প্রথম অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার অভিনয়ে শুরু। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র বুলবুল আহমেদ পরিচালিত ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’। ২০১৩ সালে তিনি সর্বশেষ চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনীত জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেইলি সোপ ‘গুলশান এভিনিউ’, ধারাবাহিক নাটক ‘নন্দিনী’, ‘ঘটক বাকি ভাই’ ও ‘নীল জোছনায় কালো সাপ’। লিনা ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন তিনি, চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
জবা চৌধুরী: ‘জিঘাংসা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় শেষে এ চলচ্চিত্রের প্রযোজক আবু তাহেরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাম্পত্য জীবনে তার কোনো সন্তান ছিলো না। তিনি ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় বসবাস করেন। ২০২০ সালে তার মৃত্যুতে তিনি পুনরায় আলোচনায় আসেন। বাংলাদেশের মূলধারা জাতীয় দৈনিকে তাকে হারিয়া যাওয়া চিত্র নায়িকা দাবি করা হয়। তাকে নিয়ে দেশটির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে শিরোনাম করে ‘৪৫ বছর পর নায়িকার খোঁজ মিলল মৃত্যুর খবরে’
জীবন রহমান: বছরের শুরুতেই (১৬ জানুয়ারি) মারা যান চলচ্চিত্র পরিচালক জীবন রহমান। তিনি ১৫টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। নব্বই দশকের শুরুর দিকে তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘গহর বাদশা বানেছা পরী’ মুক্তি পায়। তার পরিচালিত ‘প্রেম যুদ্ধ’ ১৯৯৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। চলচ্চিত্রটিতে সালমান শাহ তার জীবনে প্রথমবারের মত কোনো চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘আজকের সন্ত্রাসী’ ও ‘আশার প্রদীপ’ এর মত চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন।
সেলিম খান: ১১ ডিসেম্বর প্রয়াত হন অডিও-ভিডিও প্রযোজনা সংস্থা ‘সংগীতা’র কর্ণধার সেলিম খান। মৃত্যুর আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।
সেলিম আহমেদ: অভিনেতা, শিল্পনির্দেশক ও প্রচ্ছদশিল্পী সেলিম আহমেদ মারা গেছেন ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ।