সাবেক ছাত্রলীগ নেতা থেকে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে ওঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট গুলজার হোসেন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের ৩০৪ নং কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন।
নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। তিনি বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ আদর্শের সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতাপূর্ব ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন ৷ বীর মুক্তিযোদ্ধা গুলজার হোসেন ১৯৬১ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন।
শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগের বিপ্লবী শাখা ‘নিউক্লিয়াসেরও ‘সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ময়মনসিংহের প্রতিটি গ্রামে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি প্রচার করেন তিনি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির আন্দোলন ও ছয় দফা, এগার দফার আন্দোলনে নেত্রকোনা মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’অন্যতম নেতা ছিলেন গুলজার হোসেন৷
এমনই আন্দোলন মুখর সময়ে তিনি স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য জাপান যাওয়ার সুযোগ পান। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাড়িতে তার আশীর্বাদ নিতে গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন, তোদের নিয়ে আমি বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন দেখি।
তোরা যদি না থাকিস তাহলে কিভাবে হবে। যাস না, দেশটা স্বাধীন হলে সব পাবি। তখন আর জাপান যাওয়া হল না গুলজার হোসেনের। এর মাঝে ১৯৭০ সালে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে ভিপি নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৭০ সনে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের’ নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে নেত্রকোনায় নৌকার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালান তিনি। ভাটি বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যান নৌকার প্রচারণায়। সেই প্রথম বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন মোহনগঞ্জের গাগলাজুর গ্রামে।
১৯৭১ সনে অসহযোগ আন্দোলনে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে সারা জেলায় মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের রসদ সংগ্রহের নেতৃত্ব দেন গুলজার হোসেন৷
মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সনে মুজিব বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। দেরাদুনের ভারতীয় আর্মি হেড কোয়ার্টারে প্রশিক্ষণ নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যুব সমাজকে একত্রিত ও গঠনমূলক দেশ গড়ার কাজে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ১৯৭২ সনে আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর গুলজার হোসেন তখন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৫ সালে নেত্রকোনায় বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির ডাকে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন ও নিজে জেলা বাকশালের সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সে কালো রাতেই ঢাকায় গ্রেপ্তার হন গুলজার হোসেন।
তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আর্মি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। নির্মম নির্যাতন ও মৃত্যু ভয় তাকে সেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
২৮ দিন পর এক মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ অফিসারের সহায়তায় সেখান থেকে পালাতে সমর্থ হন সমর্থ হন তিনি। তারপর তিনদিন এই পুলিশ অফিসারের বাড়িতে আত্মগোপনে থেকে চলে যান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধে।
১৯৭৬ সালে সচিবালয়ের সামনে থেকে আর্মিরা আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আর্মির ইন্টারোগেশন সেলে। সেখানেও আর্মির নির্মম নির্মম নির্যাতন ও জিয়ার প্রলোভনও গোলজার হোসেনকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শচ্যুত করতে পারেনি।
তিনি সেদিন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যেদিন গিয়েছিলাম সেদিনই মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে ছিলাম, আপনারা আমাকে মেরে ফেলতে পারেন তবে আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারবেন না, আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করেই যাব।
আদর্শিক ধারার ত্যাগীদের কেন এমন পরিণতির শিকার হতে হচ্ছে? কেন তাদের খবর রাখছেনা কেউ?
আওয়ামী লীগকে তাদের জীবন যৌবন উৎসর্গের পরিণতি হল অর্থাভাবে আজ তারা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম শফির আজ খবর রাখেনা কেউ।
২০০১-২০০৬ পর্যন্ত দলের দুঃসময়ে নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে দলের কাজে ব্যয় করেছেন তিনি। দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে যাচ্ছে তার। অতি দ্রুত তার চিকিৎসা করাতে না পারলে তিনি দ্রুত মৃত্যু বরণ করতে পারেন।
ইতোমধ্যে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীকে নীরবে নিভৃতে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তাদের মাঝে বোয়ালমারী সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি ও বোয়ালমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তারিকুল ইসলাম কামাল এবং আরেক জন আলফাডাঙ্গা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান মাসুদ।
উভয়েই বিনাচিকিৎসায় মারা গেছেন৷ এরশাদ ও বিএনপি জামাত বিরোধী আন্দোলনে তাদের বিশাল ভূমিকা ছিল। অনেকে তাদের তৈরি করা পথে রাজনীতি করেই আজ এমপি এবং জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। কিন্তু কেউ তাদের চিকিৎসার কোন খবর নেয়নি। এবং দায়ভারও নেননি।
অভিনেতারা রাজনৈতিক সরকারের কাছ থেকে অনুদান পায় কিন্তু কিন্তু ত্যাগী নেতারা পায়না এমনটি কেন হচ্ছে? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী স্বপন চন্দ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন আজ।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে তার নামে একলাখ টাকা অনুদান মঞ্জুর হয়েছিল। কিন্তু তিনি চেক ইস্যু হওয়ার পরেও চেক পেলেন না। অসহায় স্বপন চন্দ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন।
কিন্তু কোন কাজ হয়নি৷ কেন এমনটি হচ্ছে? একজন ক্যানসার রোগী চেক পেয়েও চেকটি হাতে পেলেন না কেন? এমনটি হওয়ার দায় কার? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব খবর কেন জানতে পারছেন না? কিন্তু তাঁর পক্ষে কি সব খবর রাখা সম্ভব?
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে থেকেও কেউ কেউ এসব অসহায় নিবেদিতপ্রাণদের দুর্দশার কারণ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত নয় কি?
আমরা তারিকুল ইসলাম কামাল ও মাসুদুর রহমান মাসুদের মত গুলজার হোসেন ও এস এম শফির বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু চাইনা।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সুদৃষ্টি তারা পাবেন কি? অভিনেতারা ৩৫ লক্ষ টাকা পাবে আর ত্যাগী নেতারা মাত্র ১ লক্ষ টাকার চেক পেয়েও পাবেন না, এমন ঘটনা কেন হচ্ছে? তাও খুঁজে বের করতে হবে৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)