ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের শিকড় আকৃতির বাড়তি অংশ সফলভাবে অপসারণে চিকিৎসকদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিরল রোগে আক্রান্ত বিশ্বের চতুর্থ ‘ট্রি ম্যান’ বা বৃক্ষমানব নামে পরিচিত আবুল বাজানদার।
শনিবার প্রথম পর্যায়ের অস্ত্রোপচার সফলভাবেই শেষ হওয়াতে ‘বৃক্ষ মানব’ আবুল বাজানদার ফিরে পেতে শুরু করেছেন প্রায় পনের বছর আগের স্বাভাবিক হাতের অনুভূতি। শিকড় অপসারনের পর তিনি ভারমুক্ত ডান হাতটি নিয়ে যেন নতুনভাবে জীবন ফিরে পেয়েছেন। শিকড়ের ভারমুক্ত স্বাধীন জীবনের নতুন এক মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করেছেন তিনি।
দেশের চিকিৎসা সেবার ইতিহাসে অন্যতম সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে বৃক্ষমানবের ওই অস্ত্রোপচার। বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারের ওই অস্ত্রোপচার কার্যক্রম সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিলো চ্যানেল আইসহ দেশের কিছু গণমাধ্যমের। অপারেশন থিয়েটারে সুযোগ্য চিকিৎসকদের সাথে কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী যখন প্রবেশ করে, তখন বাইরে অপেক্ষায় ছিলো আবুল বাজানদারের পুরো পরিবার আর ফলাফল জানতে অপেক্ষায় ছিলো বিশ্ব গণমাধ্যম ও উন্নত বিশ্বের চিকিৎসক সম্প্রদায়।
ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে শনিবার অস্ত্রোপচার শেষে বেলা সোয়া দুইটার কিছু পরে আবুল বাজানদারকে পাঠানো হয় পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে। সেখান থেকে রাতেই স্থানান্তর করা হয়েছে হাসপাতালে তার জন্য নির্ধারিত পাঁচ শ’ দশ নম্বর কেবিনে। ওই সময় আবুল বাজনদারের পাশে ছিলেন স্ত্রী হালিমা বেগম, একমাত্র কন্যা তাহেরা এবং আবুলের মা ও বাবা।
কেবিনে পৌঁছে আবুল বাজানদার কৃতজ্ঞতা জানাতে ফোন করেন বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও তার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ডাক্তার সামন্ত লাল সেনকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরে তিনি চিকিৎসকদের তার ডান হাতে সামান্য ব্যথার কথাও জানান।
পনের বছর আবুল বাজানদার শরীরে শিকড়ের মতো বাড়তি অংশের ভারে কার্যত অক্ষম হয়েই চলাফেরা করছিলেন। পেশায় ভ্যানচালক আবুল একসময়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতেও অক্ষম হয়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়েন। গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে খবর প্রকাশের পরেই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের আলোচনা-আগ্রহ তৈরি হয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তার চিকিৎসা সহায়তার সাথে সাথে তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইনস্টিটিউটে বিশেষ মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
বিশেষজ্ঞ প্লাস্টিক সার্জন এবং আবুল বাজানদারের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কামাল বলেন, ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টেন এর সংক্রমণ ঠেকিয়ে সম্পূর্ণভাবে রোগ মুক্তির জন্য আবুল বানাজদারের ‘ডিএনএ ম্যাপিং’ করে ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট’র প্রয়োজন হবে। এর আগে আবুলের শরীরের বাড়তি অংশ অপসারণে পর্যায়ক্রমে আরো অস্ত্রোপচার লাগবে। আর ৩-৪ সপ্তাহ পরেই হবে পরবর্তী অস্ত্রোপচার।
আবুলের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের আরেক চর্ম রোগ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কবীর চৌধুরী বলেন, ‘হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস’-‘টেন’ জনিত বিরল এক রোগে ভুগছেন বৃক্ষমানব আবুল বাজানদার। জেনেটিক ঐ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে অস্ত্রোপচারের সময়ই নেয়া হয় বিশেষ সুরক্ষা। ডান হাতের বাড়তি অংশ অপসারণে ব্যবহার করা হয় ‘ডায়াথার্মি’ বা ‘ইলেকট্রিক রে’।
তিনি আরও জানান, ত্বকের উপরের এবং ভেতরের ত্বকের পূর্নগঠনে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ। এই পুরোটা সময় আবুল বাজানদারকে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখবেন তারা। অপসারণ করা বাড়তি অংশের ত্বকের পূর্নগঠন দেখবেন। শারীরিক ফিটনেস এবং তার পুষ্টি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন চিকিৎসকরা। পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়া ও লন্ডনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত বিশ্লেষণ করে পরবর্তী কর্মপন্থা নিধারণ করবেন তারা।
চিকিৎসকদের বক্তব্যমতে আগের তিনটি বিশ্ব খ্যাত বিরল বৃক্ষ মানব এর চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যালোচনায় আবুল বাজানদারকে আরো কয়েক বারই তাদের কাঁচি-ছুরির নিচে যেতে হবে। সবমিলিয়ে বছর খানেক সময় লাগতে পারে বৃক্ষমানবের সুস্থ হয়ে উঠতে।