অনিল কৃষ্ণ বিশ্বাস বা অনিল বিশ্বাস, একজন ভুলতে বসা অসামান্য সংগীতজ্ঞের নাম। যিনি গায়ক মুকেশকে প্রথম সিনেমায় প্লে-ব্যাক করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, ‘পেহলি নজর’ ১৯৪৫। মুকেশ ছিলেন কুন্দনলাল সায়গলের একজন অন্ধ ভক্ত! তিনি সায়গলকে অনুকরণ করে গাইতেন। অনিল বিশ্বাস মুকেশকে তার নিজস্ব গায়কি খুঁজে পেতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
১৯৪৯ সালে ‘আরজু’ চলচ্চিত্রে তালাত মাহমুদকে প্রথম ব্রেক দেন। তালাতের কাঁপা কণ্ঠ সেসময় অনেক সংগীত পরিচালক অপছন্দ করেছিলেন। কিন্তু অনিল বিশ্বাস তালাতকে বলেছিলেন, ‘না তুমি তোমার এই স্টাইলকেই লালন কর।’ এভাবেই ভেলভেট ভয়েস তালাত মাহমুদ সেই স্বর্গীয় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মেলোডির স্রোতে ভারতবর্ষকে ভাসিয়ে দেন! অনিল বিশ্বাস লতা মঙ্গেশকরকেও তৈরি হতে অনেক ভূমিকা রেখেছেন। লতাকে দমের ব্যাপারে কোচিং করিছেন। সকলেই তার কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন অসঙ্কোচে।
ইন্ডিয়ান ফিল্ম মিউজিকের জনক বলা হয় রাইচাঁদ বড়ালকে। আর অনিল বিশ্বাস ছিলেন ‘আঙ্কল’! অনিল নিজেই মজা করে এটা বলতেন। আজ যে অর্কেস্ট্রাল মিউজিকের ব্যবহার তার শুরু তারই হাতে। অথচ আমরা খবরই রাখি না, এই মানুষটির জন্ম এই বাংলাদেশের বরিশালের এক ছোট্ট গ্রামে! ১৯১৪ সালের ৭ জুলাই তার জন্ম। পিতা জগদীশ চন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন একজন সরকারি সাধারণ কর্মচারী। মায়ের ছিল সংগীতে অনুরাগ, ভজন গাইতেন। তিনি ছেলের সংগীত শিক্ষার একটা ব্যবস্থা করেছিলেন, একেবারে গোঁড়ার দিকে। সংগীত ও থিয়েটারে অনিলের উল্লেখযোগ্য আগ্রহ দেখা যায়। তিনি গান গাওয়ায় ও তবলা বাজানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন। এমেচার থিয়েটারে নিয়মিত অংশ নিতে থাকেন। খেয়াল, ঠুমরী, দাদরা ও ভক্তিমূলক গান গাইতে থাকেন।
অবিভক্ত ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ অধীন। চারিদিকে নানা ধরণের অস্থিরতা। ছাত্র অনিল জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। অনেক বোমা হামলায়ও তিনি জড়িত ছিলেন। অন্তত ছয়টি ঘটনায় তিনি জেলে গিয়েছেন। তখনও তার ম্যাট্রিকুলেশন হয়নি! তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের ফলে লেখাপড়া চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৩০ সালে অনিলের পিতার মৃত্যু হলে বাধ্য হন কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে। গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি ছদ্মবেশে কলকাতায় চলে যান। আরও অনেক গ্রেট ম্যানদের মতই ‘সিটি অব জয়’ এ তার জীবন শুরু হয়েছিল রাস্তায়! কঠিন জীবন। শুরুতে খুব সামান্য ছোটোখাটো কাজ করতে হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে এক প্রাইভেট সংগীত শিক্ষকের চাকরি পান। তবে তার অতীত এখানে এসে হানা দেয়। পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে। আবার জেলে যান।
জেল থেকে বের হবার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি মেগাফোন কোম্পানিতে কাজ পান। তাকে এই কাজ পাইয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এখানে তিনি গান গাওয়া, অভিনয় করা বাদ্যযন্ত্র বাজানো সব কাজই করেছেন। প্রতিটি গান রচনা ও কম্পোজ করার জন্য পেতেন ৫ টাকা। ততদিনে তিনি শ্যামা সংগীত ও কীর্তন গায়ক হিসেবে পারদর্শী শিল্পী হয়ে উঠেছেন। এখানে তিনি প্রচুর গানের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। এখান থেকে তিনি যোগ দেন রঙ মহল থিয়েটারে। রঙ মহলে বছর তিনেক কাজ করার পর তিনি হীরেন বসুর সঙ্গে বোম্বে যান। সেখানে কুমার মুভিটোন এ কাজ পান। তারপর কাজ করেন রাম দারিয়ানির সঙ্গে।
১৯৩৫ সালে তিনি প্রথম সিনেমার গান কম্পোজ করেন, ‘ধরম কি দেবী’ সিনেমায় প্রথম তার নাম স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়। ১৯৩৭ সালে ‘জাগিরদার’ সিনেমার জন্য গান তৈরি করেন। এই সময় থেকেই তার সঙ্গে মেহবুব খানের সখ্য তৈরি হয়। এই সময় অনিল বিশ্বাস ফিল্মে ১২ পিস অর্কেসট্রার প্রবর্তন করেন। মেহবুব খান পরিচালিত ‘রোটি’ (১৯৪২) সিনেমায় তিনি আখতারী বাঈ ফয়জাবাদীকে (বেগম আখতার) ফিল্মে ফিরিয়ে আনেন। ১৯৪২ সালেই অনিল বিশ্বাস বোম্বে টকিজে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে ‘কিসমত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অনিল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান। কিসমত কোলকাতার একটি প্রেক্ষাগৃহে রেকর্ড সৃষ্টি করে টানা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়! ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শোলে’ পর্যন্ত এই রেকর্ড অটুট ছিল! তবে শোলের জনপ্রিয়তা গানের জন্য নয়, এর উত্তেজনাকর গল্পের জন্য।
কিসমতের মাধ্যমে নায়ক অশোক কুমার ইন্ডিয়ান ফিল্মের প্রথম এভারগ্রিন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান। ১৯৪৫ সালে ‘পেহলি নজর’ সিনেমায় মুকেশ অনিল বিশ্বাসের সুরে রেকর্ড করেন তার কালজয়ী সেই গান ‘দিল জালতা হ্যায়’। মুকেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান প্রথম সারির প্লে ব্যাকগায়ক হিসেবে। অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি সংগীত পরিচালনা করেছেন। কয়েকটির নাম এখানে উল্লেখ করছি- ধরম কি দেবী (১৯৩৫), জেন্টল ম্যান ডাকু (১৯৩৭), জাগিরদার (১৯৩৭), কোকিলা (১৯৩৭), ওয়াতান (১৯৩৮), হাম তুম আওর ওহ (১৯৩৮), জীবন সাথী (১৯৩৯), পূজা (১৯৪০), আওরত (১৯৪০), আলীবাবা (১৯৪০), কিসমত (১৯৪৩), পেহলি নজর (১৯৪৫), আরজু (১৯৫০), পরদেশি (১৯৫৭), অভিমান (১৯৫৭), ছোটি ছোটি বাঁতে (১৯৬৫)। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রে নানা পরিবর্তন আসে। প্রযুক্তি দ্রুত এগুতে থাকে। মানুষের রুচিতে আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। অনিল বিশ্বাস এসবের অনেক কিছুই মেনে নিতে পারেননি। সংগীতের নামে সুরহীন, মেলোডিহীন চেঁচামেচি তিনি গ্রহণ করেননি। চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ডিরেক্টর পদে যোগ দেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৮৪ সালে দূরদর্শনের প্রথম টেলিভিশন সিরিয়াল ‘হাম লোগ’ এর জন্য তিনি সংগীত পরিচালনা করেন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি দূর দর্শনের জন্য আরও কিছু কাজ করেন। তিনি দুই বছর জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদ মর্যাদায় উপদেষ্টা (সংগীত) পদে বহাল ছিলেন।
তার প্রথম স্ত্রী আশালতা, তিনিও একজন অভিনেত্রী ছিলেন। তাদের তিন পুত্র ও এক কন্যা। ১৯৫৪ সালে আশালতার সাথে তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৫৯ সালে অনিল বিখ্যাত প্লেব্যাক গায়িকা মীনা কপুরকে বিয়ে করেন। তাদের কোন সন্তান ছিল না। ১৯৮৮ সালের হিট সিনেমা ‘শাহেনশাহ্’ এর সংগীত পরিচালক ‘অমর-উৎপল’ জুটির উৎপল বিশ্বাস অনিল বিশ্বাসের ছেলেদের একজন। অনিল বিশ্বাসের বোন পারুল বিশ্বাসও সেকালের একজন নামজাদা গায়িকা ছিলেন। পারুল বিশ্বাস ছিলেন পরিচালক, বংশীবাদক পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের স্ত্রী।
নয়া দিল্লীতে ২০০৩ সালের ৩১ মে অনিল বিশ্বাস পরলোক গমন করেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)