মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণকে বিতর্কিত করে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে। ভারতীয় গণমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’র একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ও সূচনাকে পুঁজি করে প্রচার করা হচ্ছে, ১৬ ডিসেম্বর ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো পাকিস্তান। অথচ ভারতীয় অন্যান্য মিডিয়ায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত দলিলে আছে, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিলো মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বিত যৌথবাহিনীর কাছে।
আত্মসমর্পণকে বিতর্কিত করার চেষ্টার পেছনো কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন বিশিষ্টজনেরা।
অনলাইনে অপপ্রচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হলেও প্রজন্মের ওপর আস্থা রাখেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন,“নতুন প্রজন্ম অনির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম থেকে ইতিহাস শিখবে না। তাদেরকে ইতিহাস জানতে হলে প্রচুর পড়তে হবে। আর অপপ্রচার তো ইতিহাসে স্থান পাবে না”।
তিনি আরও বলেন,“দলিল, তথ্যসহ একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন করে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছিলো। সে যুদ্ধে পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান সরাসরি ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পূর্ব রণাঙ্গণে বিষয়টি ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পূর্ব রণাঙ্গনে যৌথবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ হচ্ছিলো। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব রণাঙ্গনে যৌথবাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করে”।
তাঁর এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিলে। যে দলিলে অরোরা-নিয়াজি স্বাক্ষর করেন, তার শুরুতেই স্পষ্ট ‘যৌথবাহিনী’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। ওই দলিলের সূচনায় লেখা আছে,‘পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশী যৌথবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ লেফটেনেন্ট জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো’।
সূচনা ও শিরোনামে যাই লেখা থাকুক ইন্ডিয়া টুডে’র ওই প্রতিবেদনের একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘এই যুদ্ধ ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল’। কৌশলে প্রতিবেদনের এই অংশ এড়িয়ে গিয়ে অপপ্রচারকারীরা বলার চেষ্টা করছেন এটা ছিলো পাক-ভারতযুদ্ধের চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা।
এমন দাবি অনলাইন সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়ালেও একে শত্রুদের স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তার ভিন্নধারার অপপ্রচার বলে মনে করেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার। সরাসরি বিরোধীতা করে জনবিচ্ছিন্ন না হয়ে ভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে এবং স্বতঃস্ফুর্ত বিজয় উদযাপনে সংশয়ের জন্ম দিতেই এধরণের অপচেষ্টা হচ্ছে বলে চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান তিনি।
ইমরান বলেন,“সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করলেও বর্তমান সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে কৌশল পাল্টেছে। অপপ্রচারকারীরা বলছে তারা বাংলাদেশের পক্ষে! কিন্তু ভারত নাকি আধিপত্য করছে। আধিপত্য প্রমাণে তারা নানা উদাহরণ ও মিডিয়ার ভুল সংবাদও হাজির করছে”।
মুক্ত তথ্যভাণ্ডার উইকিপিডিয়ার একটি ছবি দিয়ে বলার চেষ্টা হচ্ছে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না।
এ বিষয়ে ইমরান এইচ সরকার বলেন,“যে ছবি দিয়ে এটা বলা বলা হচ্ছে, তা আসলে গোটা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মূল অংশের একটি ক্লোজ ফ্রেমের ছবি। ছবিতে ভারত-পাকিস্তানের সামরিক অফিসারদেরই শুধু দেখা যাচ্ছে। এটাও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাজ। কারণ মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে বীর প্রতীক এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) একে খন্দকার সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন”।
আত্মসমর্পণে বাংলাদেশের প্রতিধিত্ব ও যৌথ কমান্ডের বিষয় সম্পর্কে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র বলেন,“আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন না। সামরিক পদমর্যাদার ভিত্তিতে সেখানে বাংলাদেশের তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান একে খন্দকার ছিলেন। আর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে ভারত সেনাবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। আত্মসমর্পণ দলিলে ভারতীয় সেনা প্রধান হিসেবে নন বরং যৌথবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বাক্ষর করেন জগজিৎ সিং অরোরা। আত্মসমর্পণের দলিলে তাঁর স্বাক্ষরের ঠিক নিচে ‘ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান’ কথাটি স্পষ্ট করে লেখা আছে”।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি বড় ভূমিকা আছে, তাই তাদের ‘বিজয় দিবস’ উদযাপন নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ নেই বলেও মনে করেন ইমরান। তার মতে,“শুধু ভারত কেনো, বিশ্বের যেকোনো দেশ বাংলাদেশের বিজয় দিবস উদযাপন করতে পারে”।
“মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গর্বে আজও দেশীয় দোসরদের গাত্রদহন হয়, এমন অপপ্রচার সেটাই প্রমাণ করে। এরা পাকিস্তানিদের চেয়েও বড় পাকিস্তানি” বিজয়কে বিতর্কিত করার অপচেষ্টার জবাবে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভাস্কর ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী।
তিনি বলেন,‘ যখন পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে তখন আমি যশোরে। সেসব ভুলে যাইনি। মিত্রবাহিনীর প্রধান ছিলেন অরোরা। তাই তার কাছেই আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানিরা। এখানে বিজয় বেহাত হওয়ার প্রশ্ন তোলাটা স্বাধীনতাবিরোধীদের অপকৌশল। তাদের মিথ্যার ফাঁদে পা না দেয়াই ভালো। ফেসবুক-অনলাইনে এখন বিভ্রান্তি ছড়ানোও সহজ। এইসব জন্তু-জানোয়ারের কথায় কান না দেয়াই শ্রেয়”।
এধরণের অপপ্রচারের মাধ্যমে দুই দেশের মৈত্রী এবং মিত্রবাহিনীর অবদানকেও খাটো করে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করেন একাত্তরের এই সরব সাক্ষী। তাঁর মতে “পরাজিত শক্তি সবক্ষেত্রে হেরে গিয়ে এখন নিষ্ফল আক্রোশে মিথ্যাচারে ব্যস্ত”।