চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অদৃশ্যমান প্রতিবন্ধীদের কেনো দৃশ্যমান কর‍া জরুরি

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ সব মৌলিক ও প্রয়োজনীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস গুরুত্বসহকারে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘ইনক্লুশন ম্যাটার্স: একসেস এন্ড এমপাওয়ারমেন্ট ফর পিপল অফ অল এবিলিটিস’। বাংলায় এর ভাবানুবাদ করা হয়েছে, ‘একীভূতিকরণ: প্রতিবন্ধী মানুষসহ যার যার সামর্থনুযায়ী সকলের প্রবেশাধিকার ও ক্ষমতায়ন’।

বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটিরও অধিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সহায়ক পরিবেশ না থাকায় অধিকাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি প্রযুক্তি-কারিগরিসহ সবরকম শিক্ষা, যাতায়াত, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সামাজিক ও রাজনীতিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে রয়েছে। অথচ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত করা গেলে যে কোন দেশের উন্নয়নে গতি পাবে মনে করা হয়। এজন্য যে কোন উদ্যোগে বা উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রতিবন্ধী মানুষসহ সবার অংশ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টির কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করতে এ বছরের প্রতিপাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহরের সর্বত্র প্রতিবন্ধী মানুষের চলাচলসহ নিশ্চিত করাসহ শহর পরিসেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি, প্রতিবন্ধী মানুষদের সম্পর্কিত তথ্য ও পরিসংখ্যান হালনাগাদ করা এবং অদৃশ্যমান প্রতিবন্ধী মানুষদের দৃশ্যমান করতে সব উন্নয়ন কার্যক্রমে ও সমাজের সর্বত্র তাদের বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

প্রসঙ্গত; ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ-এর সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রতিবছরের ৩ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ হিসাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১০ভাগ বলে উল্লেখ করেছে। যদিও তাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান একটি প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হার ১৬ভাগ বলে উল্লেখ করে। ১০ভাগ ধরে নিলেও বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লক্ষ হলেও এদের অধিকাংশই অদৃশ্যমান। কারণ, প্রতিবন্ধী মানুষদের চলাচল ও প্রবেশগম্যতা উপযোগী পরিবেশ দেশের কোথাও নেই। শুধু চলাচল অসুবিধার কারণেই অনেক প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা কষ্ট করে চলাচল করছে, তারা আবার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। অথচ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা ও চলাচল নিশ্চিত করার কথা আইনেও বলা হয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩’-এর ধারা ২-এর উপধারা ১৩-এ বলা হয়েছে; “প্রবেশগম্যতা অর্থ ভৌত অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্য, এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সকল সুবিধা ও সেবাসমূহে অন্যান্যদের মত প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তির অধিকার”।

ধারা ৩৪, উপধারা ২-এ বলা হয়েছে; “সর্বসাধারণ গমন করে এইরূপ বিদ্যমান সকল গণস্থাপনা, এই আইন কার্যকর হইবার পর, যথাশীঘ্র ও যতদূর সম্ভব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আরোহন, চলাচল ও ব্যবহার উপযোগী করিতে হইবে।” ‘জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা ২০১৩’-এর ৪.৪.১-এ পথচারীদের জন্য পায়ে চলার পরিবেশ মানোন্নয়ন, বিশেষত শিশু, মহিলা, বয়স্ক এবং শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের (প্রতিবন্ধী ব্যক্তি) ব্যবহার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; ৪.৪.৪-এ রেলস্টেশন ও বাস স্টপে র‌াম্প ব্যবহার এবং নৌ-পথে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত সহজীকরণ; ৫.১.৫-এ শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পথচারীদের ফুটপাথ ওঠানামা সহজতর করার লক্ষ্যে ঢালু পথ (রাম্প) এর সংস্থান এর কথা বলা হয়েছে। আইনে ভাল ভাল কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না। এ বছরের জুন মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্পর্কিত নির্দেশনা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে ওয়াশ রুম ও সিড়িতে মোশন সেন্সর লাইট (মানুষের চলাচলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠা ও নিভে যাওয়ার সেন্সরড্ বাতি), পানির ট্যাঙ্কিতে মোশন সেন্সর (পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি পূর্ণ হয়ে মেশিন বন্ধ হবে) ও বিকল্প বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল লাগানোর নির্দেশনা প্রদান করা হলেও ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগামিতা ও স্বতন্ত্র বাথরুম নির্মাণ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এরকম ভুল নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত করে তুলছে।

এমন ভুল কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা নীতি ও শিশু নীতি প্রণয়ন করেছে এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদসমূহে স্বাক্ষর করেছে। শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতিও রয়েছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকাংশই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর মতে, বাংলাদেশে ৯০ভাগ প্রতিবন্ধী শিশু বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সুযোগ পায় না।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এর মতে, পথশিশুদের ৩০ভাগ প্রতিবন্ধী; যারা লেখাপড়ার বাইরে থাকছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বহুবিধ পদক্ষেপ দরকার। কারণ, বাক-শ্রবণ-দৃষ্টিসহ বিভিন্ন রকমের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য ইশারা ভাষায় শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। যাতায়াতে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা প্রায় সব অধিকারবঞ্চিত।

বাস, ট্রেন, লঞ্চ ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত গণপরিবহনগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের উঠা-নামার সুযোগ নাই। বাস ও ট্রেনের প্রবেশ পথ অনেক উঁচু যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য সহায়ক নয়।

অন্যদিকে লঞ্চ স্টেশনে প্রবেশ থেকে শুরু করে লঞ্চে উঠার পথ আরও কষ্টসাধ্য। পেশাগত প্রয়োজনে ভ্রমণের কারণে অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখেছি, বাসগুলো ফুটপাথের সঙ্গে এবং ট্রেন ও লঞ্চ প্ল্যাটফর্মে সঙ্গে সমান্তরালভাবে দাড়ায়। ক্ষেত্রবিশেষে, বাসের মধ্যে এক্সট্রা রাম্পও লাগানো থাকে। ফলে যে কোন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি একাই বাসে, ট্রেনে ও লঞ্চে উঠতে ও নামতে পারেন

হুইল চেয়ার/ক্র্যাচ/সাদাছড়ি ব্যবহারকারী কোন প্রতিবন্ধী মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে শুধু শহরের ফুটপাথে বা যানবাহনে নয়, দেশের কোথাও এককভাবে চলাচলের কোন পরিবেশ নেই। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অন্য কোন সেবা গ্রহণের সুযোগ ও জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখার থেকে বঞ্চিত হয় প্রতিবন্ধী মানুষ। এ কথা সত্য, ঢাকাসহ সব শহরের কতৃত্ববাদী সংস্থাগুলো সব মানুষের চলাচল উপযোগী পরিবেশই নিশ্চিত করতে পারেনি।

কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষসহ সবার জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী,স্বাছন্দ্যময় যাতায়াত গড়ে তুলতে কোন উদ্যোগও লক্ষ্যনীয় নয়। এখনও ঢাকার ফুটপাথগুলো সমান্তরাল করা হয়নি। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন বানাতে গিয়ে ভবন মালিকেরা ফুটপাথ কেটে একটু পরপর ভবনের প্রবেশ পথ করেছে। পাশাপাশি প্রধান সড়ক থেকে ছোট রাস্তায় প্রবেশের জন্যও একটু পরপর ফুটপাথ কেটে উচু-নীচু করা হয়েছে।

অথচ পৃথিবীর কোথাও এ নিয়ম নেই। ফুটপাথ সমান্তরাল থাকবে, রাস্তা ও ভবনের প্রবেশ পথ উচু-নীচু হবে। কারণ; গাড়ি খুব সহজে সামান্য উচুতে উঠতে বা নামতে পারে। স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে, রাজধানী ঢাকা দু’সিটি করপোরেশনে বিভক্ত হলো। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য উড়াল সড়ক নির্মাণ হয়েছে। অথচ পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে আরও কম টাকায় আধুনিক ও উন্নত শহর গড়ে তোলা সম্ভব।

মানুষের জীবনমান উন্নত করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অদক্ষ, বিলাসী ও ব্যয়বহুল পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ বেশি থাকায় সার্বিক উন্নয়নের সুযোগ থেকে অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত। এ কারণেই কোন শহরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

আমরা মধ্য আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত হবার স্বপ্ন দেখছি। এ স্বপ্ন কার্যকর করতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা দরকার। দক্ষ জনশক্তির জন্য যাতায়াত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশগমনের সুযোগসহ সবরকম উন্নয়নে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা দরকার।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)