আর সহ্য হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেবলি কথার কথা। কেউ কিছু করছে না। কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। উচ্চ আদালত নির্দেশ দিচ্ছে; তাও মানা হচ্ছে না। তাহলে উপায়? মানুষ, এই শহরের মানুষ যাবে কোথায়, কার কাছে?
বর্ষার পর থেকে পুরো ঢাকা শহর ধূলায় ডুবে থাকলো। এখন শহরের এমাথা থেকে ও মাথা মেঘের মতো ধূলা উড়ছে। ‘শহরে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে’- তা থাকুক। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় উন্নয়ন চাই, শহরের, এবং দৃশ্যমান। সেই উন্নয়ন করতে গিয়ে শহরবাসীকে যদি গভীরতম সংকটে পড়তে হয় তাহলে উন্নয়ন করে লাভ কী?
মাননীয় হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেন, ধূলা অপসারণে দু’বার পানি দিতে হবে শহরের সড়কে। কে মানে কার কথা, কার নির্দেশ! দুই সিটি করপোরেশনে ভাগ হওয়া ঢাকা মহানগরের উত্তর অংশ অভিভাবকহারা দীর্ঘ সময়। উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র আনিসুল হকের অকাল প্রয়াণে এলোমেলো হয়ে যায় সব পরিকল্পনা। তিনি এই শহরকে ভালোবাসতেন। শহর নিয়ে তার কিছু পরিকল্পনা ছিলো। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর শহরের চেহারা বদলাতে শুরু করেছিলো মাত্র। কিন্তু, ‘অযোগ্য’ এই শহর যোগ্য মেয়রকে ধরে রাখতে পারেনি বেশিদিন। আর নানা জটিলতায় নির্বাচনও আটকে ছিলো। তবে, বাধা কাটিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই পদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম। বিএনপি বা আলোচিত কোনো রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে না। তাই সব ঠিকঠাক থাকলে, আর নির্বাচন হলে আতিকুল ইসলামই উত্তর ঢাকার মেয়র হচ্ছেন। এবং তিনি বলছেন, বলে বেড়াচ্ছেন, তার প্রথম কাজ হবে ‘মেয়র আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজ’ শেষ করা। মানে আনিসুল হকের যে পরিকল্পনা ছিলো ‘ঢাকাকে বাস্যযোগ নগর’ করার; সেই পথে হাঁটবেন আতিকুল।
এটা আমাদের জন্যে এক স্বস্তির বিষয়। তবে আতিকুল চাইলেই পুরো ঢাকাকে সাজাতে পারবেন না। কেনো না ঢাকার দক্ষিণে আরেকজন মেয়র আছেন। তিনি মহান এক রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকন। মোহাম্মদ হানিফকে এই শহরের সকলে চেনে ‘মেয়র হানিফ’ বলে। এই শহরের সবচেয়ে বড়, কার্যকর ফ্লাইওভারটির নাম হানিফের নামে। তারই সন্তান সাঈদ খোকন, তিনি মেয়র হিসেবে অর্ধেক ঢাকার জন্যে কতোটা সফল হবেন তা কেবল সময়ই বলে দিতে পারবে। তবে তিনি কথার জাদুকর নামে ইতোমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছেন। অনেক ঘোষণা দিয়েও তার অংশের ফুটপাত হকারমুক্ত করতে পারেননি। যানজট নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখাতে পারেননি তিনি। তার অংশে এই শহরের ইতিহাস জানা নদী বুড়িগঙ্গা। সেই নদী বাঁচাতে মেয়র সাঈদ খোকনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখেনি নগরবাসী। আর শহরজুড়ে ধূলা, দক্ষিণ-উত্তরের একই দশা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আরো আরো অনেক সংস্থা হাতে কলমে, জরিপ করে দেখিয়ে দিচ্ছে ঢাকার বাতাস বেজায় মন্দ। এ বাতাসে বেশিদিন থাকলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হতে বাধ্য। ঢাকার বাতাসে নানা উপাদানের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ধূলা। দেশজুড়ে, মহাসড়কের দু’দিকে এখন ধূলার সমুদ্র। শীত যাই যাই করছে। আসছে এলোমেলো হাওয়ার ঋতু বসন্ত। তখন পথের ধূলা নতুন ডানা পাবে। এসব নিয়ে কারো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
উত্তরে তুরাগ নদ থেকে দক্ষিণের বুড়িগঙ্গা। সকাল থেকে মধ্যরাত, একটা বরাবর যাত্রা করলেই টের পাওয়া যাবে কতো ধুলোময় ঢাকা শহর। সড়ক থেকে আকাশের অনেকটা ওপর পর্যন্ত কেবল ধূলারস্তর। শ্বাস নেয়াই কষ্ট। জীবিকা এবং বিবিধ প্রয়োজনে লাখ লাখ মানুষকে ছুটতে হয় শহরের এমাথা-ওমাথা। ভাগ্যবান তারা, এই যাত্রায় যাদের এসি গাড়ির সুবিধা আছে। বাকিদের চলতে হয় ঝক্কড়-লক্কড় বাসে। মোটস সাইকেল সার্ভিসে। ধূলার ছোবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অনেকে নাক-মুখে এঁটে দেন মুখোশ। নগরবাসীর এই মুখোশপরা চেহারা দেখে মাঝে মাঝে শহরটাকেই ‘মুখোশ নগরী’ বলে মনে হয় আমার।
যুগ থাকলে যুগযন্ত্রণা থাকবে। নগরে বাস করতে গেলে নগর যাতনাও সইতে হবে; এটা এক ধরণের সাপ-লুড়ু– খেলা। নগরের উন্নয়ন কাজ হবে, হতেই হবে, দুনিয়ার সবখানেই হয়। তবে সভ্য নগর আর সভ্য দেশের বাসিন্দা; তারা উন্নয়ন কাজের চিত্রটা প্রকাশ্যে এভাবে মেলে ধরে না। একটু আড়ালে, ঢেকে ঢুকে কাজ চালিয়ে যায়। শহর আর দেশের উন্নয়ন করা যাদের কাজ, দায়িত্ব-ডাস্ট মেনেজমেন্টের দায়িত্বও তাদের ওপরই বর্তায়। না হলে, এই শহর অসুস্থ হলে, শহরের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে একদিন পুরো নগর ‘স্মৃতির শহর’ হয়ে যাবে। তখন মানুষ থাকবে না এই শহরে।
তাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সবিনয় নিবেদন একটু ভাবুন ঢাকার ধূলা নিয়ে। আপনারাতো দুনিয়ার অনেক শহর, কতো কতো দেশ দেখেন, ঘুরের; সেখান থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা একটু কাজে লাগান।
আর শেষমেশ বলি, আকাঙ্খা করি, শহরজুড়ে বৃষ্টি নামুক। তুমুল বৃষ্টি। মুক্তি মিলুক এই ধূলির মুলুক থেকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)