চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

অতএব পর্বতের মূষিক প্রসব

ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদের একের পর এক হত্যার পরও সরকার বলেছিলো দেশে জঙ্গি নেই। শেষে পুলিশের এক কর্মকর্তার স্ত্রীকে নির্মম ভাবে হত্যার পর পুলিশ বলছে, দেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলবে। এর মানে হচ্ছে দেশে জঙ্গি আছে। আপাতঃ তাদের নাম জেএমবি।

শুক্রবার সকাল থেকে এক সপ্তাহের জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। আর শুক্রবার সকালেই এক মন্দির সেবককে গলা কেটে খুন করা হলো। তারপর সাঁড়াশি অভিযানে জামায়াত-শিবির, বিএনপির নেতা-কর্মী আর পলাতক কিছু আসামীসহ কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর অর্থ কি এই যে, আসল খুনিদের ধরা হয়েছে?

পুলিশের বা যৌথবাহিনীর এই তৎপরতায় দেশের মানুষ যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে এমনটা নয়। একের পর এক হত্যাকাণ্ডে মানুষ যখন ভীত সন্ত্রস্ত এবং নির্বাক তখনও আইনশৃংখলা বাহিনী মানুষকে আশার আলো দেখাতে পারেনি।

আর তিনদিনে কয়েক হাজার আসামী গ্রেফতার করে পুলিশ কী বোঝাতে চাইছে জনগণকে? দেশে কি এই পরিমাণ জঙ্গিই আছে? এই এতো হুংকার, এতো তর্জন গর্জন এগুলোর শেষ পরিণতি কিছু আসামী ধরা?

জঙ্গিরা কি এতই সহজিয়া যাপন করে যে, আপনারা গেলেন আর তারা ধরা দিলেন! সমস্যার গভীরে কেনো যেতে চায় না প্রশাসন এটা বোধগম্য নয়। জনগণ এই পর্যায়ে এসে কার উপর ভরসা রাখবে? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার নিকট সকল গুপ্ত হত্যার তথ্য আছে। ভালো কথা, উত্তম কথা, যোগ্য রাষ্ট্রনায়কের কথা। কিন্তু তারপর কী? আইন শৃংখলা বাহিনী কি তার নিয়ন্ত্রণে নেই? তার নির্দেশে কি পুলিশ কিংবা অন্য বাহিনী কোনো খুনিকে ধরতে পারে না? মূল সমস্যাটা কোথায়?

আর প্রধানমন্ত্রীর এই কথা যদি হয় আপ্ত বাক্য কিংবা সান্ত্বনা, তবে আমাদের কিছু বলার নেই। যদি সত্যিই এই সব খুনিদের তথ্য তার হাতে থেকে থাকে তাহলে কেনো কালক্ষেপণ? কেনো এইসব নাটক?

আমরা স্বৈরাচার পতনের পর থেকে অতি নাটকীয় সব ঘটনা দেখে আসছি গত সিকি শতাব্দি। যদি বলা হয় এই রাজনীতি উন্নয়নের রাজনীতি, যদি বলা হয় এই সরকার আমাদের দেশের প্রগতির জন্য প্রয়োজন, তবে এ কথাও বলতে হয়, রাজনীতির ভাষাটাও পরিবর্তন দরকার। আশির বা নব্বই দশকের রাজনৈতিক ভাষা দিয়ে এখন আর আম জনতাকে বোকা বানানো সম্ভব নয়। এখন মানুষ বোঝে কী উদ্দেশ্যে কী বলা হচ্ছে? কার উদ্দেশ্যে কেনো বলা হচ্ছে। এখন রাজনৈতিক ভাষাটাও উন্নত হতে হবে। পুরনো রাজনৈতিক বাক্যবিলাসীতার দিনও ফুরিয়ে গেছে।

এখন দরকার নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য। যা সরকারের দাবি মতে উন্নয়নকে প্রতিনিধিত্ব করবে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নই সব নয়। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখি হাস্যকর অবনমন। শিক্ষা থেকে শুরু করে হেনো কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি নেই। শুধু দুর্নীতি? মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রান্তিক মানুষের জীবন এখন অসহনীয় অবর্ণনীয় কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তবু আমরা শহুরে মধ্যবিত্তরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি এই ভেবে যে নিত্য নতুন ফ্লাইওভার হচ্ছে, সেতু হচ্ছে, সড়ক হচ্ছে। এ সবই ঠিক আছে। কিন্তু গত দুই দশক আমরা প্রবল অধঃপাতে পতিত হয়েছি। নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের পতনে আমরা এখন বিশ্বে এক নম্বর। সুতরাং এইসব উন্নতি নিয়ে বড়াই করে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি পতনের পাতালে।

এই পতনের মূল্য দিতে গিয়ে একটা গোটা জাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে ইতিহাসে এই উদাহরণ বিরল নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, উন্নত দেশেও এইসব ঘটে থাকে। তিনি আমাদের বোকা পেয়েছেন। উন্নত বিশ্বের এইসব ঘটনার তাৎক্ষণিক অ্যাকশন হয় আর এগুলো সেসব দেশে কালে ভদ্রে ঘটে, যেটাকে আমরা বিচ্ছিন্ন বলতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের এইসব ঘটনা নিরবচ্ছিন্ন। প্রত্যহ ঘটে যাচ্ছে। তিনি উল্টো বলছেন, আমাদের দেশের এইসব হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন!

এইসব হাস্যকর কথার দিন ফুরিয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে একটা জবাবদিহিমূলক সরকারই হতে পারে উন্নতি প্রগতির প্রতীক। পুঁজিবাদের একটা নিম্নতর স্তরে আমরা হাঁটি হাঁটি পা করে এগুনোর চেষ্টা করছি। বিকলাঙ্গ পুঁজির ন্যায় এখানে সাংস্কৃতিক মানও বিকলাঙ্গ। আমরা আপাত এই সাংস্কৃতিক দৈন্যতা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা চাই নিরন্তর নিরবচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড গুলোর বিচার এবং এসবের প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপ। আপাতত এটুকু করলেই আমাদের একটু শান্তির ঘুম হবে। বাকি সব বিষয় না হয় এখন উহ্য থাকুক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)