চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

অগ্রগতির পথে নতুন স্বপ্নে, নতুন বছরে বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর সমান হতে না পারলেও জীবন যাত্রার মানের দিক থেকে অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে। এমন কি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও ভালো জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের মানুষ। দারিদ্র্য, আয়ের বৈষম্য, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া কমেছে; বেড়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়ন। এসবের প্রভাবে বেড়েছে গড় আয়ু। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)’র এমন স্বীকৃতি সঙ্গে নিয়ে আরো উন্নত জীবনের স্বপ্নে নতুন বছরে পদার্পণ করলো বাংলাদেশ।

বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে, ৯০ দশকেও বাংলাদেশের ৫৭ ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করতো। এখন এ হার ৩১ দশমিক তিন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)‘র মতে মূলতঃ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে। পাশাপাশি ৮০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো অর্থ, ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের জাতীয় অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তি এবং কৃষিতে সবুজ বিপ্লব রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, সরকার জিডিপির বড় একটা অংশ সামাজিক খাতে ব্যয় করছে যা বাংলাদেশের সামাজিক খাতকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হয়েছে। মাত্র শেষ হওয়া ২০১৫ সালের বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়েছে যে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃতু, গড় আয়ু, জনসংখ্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের ১৪২টি দেশকে পেছনে ফেলেছে।

নিউ ইয়র্কে ইউএনডিপি সদর দপ্তরের পরিচালক ড. সেলিম জাহানের মতে, অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশিরভাগ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার গড় হারের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে। তিনি বলেন, মানের দিক থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত স্থিতিশীল অগ্রগতির যে অর্জন তা সে বজায় রেখেছে এবং ‘আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’

তবে তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার উচ্চ হলেও এখনো ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে বেশি নয় এবং জাতীয় আয়ের ক্ষেত্রেও ‘আমরা এখনো ওই দুই দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি। মাথাপিছু আয়ও আমাদের কম। এই স্বল্প প্রবৃদ্ধি এবং স্বল্প মাথাপিছু আয় নিয়েও আমাদের অর্জন কিন্তু অনেক।

‘বর্তমান বাংলাদেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৭১ বছর যেখানে ভারত এবং পাকিস্তানের ৬৬। শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৪১, পাকিস্তানের ৮৫ এবং ভারতের ৫২। সাক্ষরতার হার বাংলাদেশের ৫৫, ভারত আর পাকিস্তানের অনেক কম। আয়ের অসমতাও ভারত এবং পাকিস্তানের চেয়ে অনেক কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান বলেন, আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে উচ্চতম ২০ শতাংশের এবং নিম্নতম ২০ শতাংশ জনগনের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে উচ্চতম শতাংশের আয় নিম্নতম শতাংশের আয়ের চেয়ে ৪ গুণ বেশি হবে। ভারত এবং পাকিস্তানের সেটা ১০ এর উপরে। ‘সুতরাং আয়ের বৈষম্যটাও আমরা অনেকটা কমিয়ে এনেছি।’তার বক্তব্য পুরোপুরি সমর্থন করে আইএমএফ। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি জনবহুল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে প্রবৃদ্ধির সাথে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমাতে সক্ষম হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এখন গড় মাথাপিছু আয় ৫২৮ ডলার আর দক্ষিণ এশিয়ার গড় আয় এক হাজার ১৭৬ ডলার। এক হাজার ৪৪ ডলার আয় নিয়ে প্রায় দক্ষিণ এশিয়াকে ধরে ফেলেছে বাংলাদেশ। আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন অনেকটাই ব্যাপ্ত। বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন অঞ্চলের জনগোষ্ঠির মধ্যে সমভাবে সমন্বিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি এবং আয়কে বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে উন্নয়নের রূপান্তর করতে পেরেছে।

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সুচক রিপোর্ট তৈরির নেপথ্যের মূল ব্যক্তি ড. সেলিম জাহান বাংলাদেশের এরকম উন্নতির পর্যবেক্ষণে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন আর কেউ বসে নেই, কেউ না কেউ কিছু কাজ করছে, তাদের মধ্যে আশাবাদ আছে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে, কর্মচাঞ্চল্যও আছে।

‘সামষ্টিক অর্থনৈতিত নীতিমালাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে মানব উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামাজিক খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। যেমন দেখা যাচ্ছে ইউনিয়ন স্বাস্থকেন্দ্র মা এবং শিশু কেন্দ্রের জন্য বিনিয়োগ হচ্ছে। আমরা প্রায়ই বলি যানজটের ফলে জীবন যাত্রা দু:সহ হচ্ছে। সে ব্যাপরে আমি বলতে পারি যে যখন একটা অগ্রগতি হয় তখন তার একটা মুল্য থাকে। যেমন যানজট, পরিবেশ দূষণ,’ এভাবেই কিছু নেতিবাচক দিকের মধ্যে ইতিবাচক বিষয়গুলো দেখেন ড. সেলিম জাহান।

বর্তমান বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার বেশি। সে কারণে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের অসমতা এবং নারীর আয়ের অসমতাও বাংলাদেশ অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে।

ইউএনডিপির সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ সমতা উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। এই সুচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৪৫। এই দেশ দুটিতো বটেই এমনকি এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশী নারীরা নিজ দেশের পুরুষের তুলনায় বেশি উন্নতি করছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, সূচকের দিক থেকে বাংলাদেশের গত বছরের চেয়ে অবস্থানগত পরিবর্তন না হলেও মানের দিক থেকে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে জীবন যাত্রার মানে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।