এক
বেশ কিছু বছর ধরে আমি কিছু লেখককে দেখছি যারা নানা কৌশল আর ছলের আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কসরত করছেন, অপচেষ্টা করছেন। অবশ্য এতে দোষের কিছু দেখি না আমি। তারা তা করতেই পারেন। এটা হয়ত সাংবিধানিক অধিকারও হতে পারে।
ইদানীং এজাতীয় লেখকেরা কথায় কথায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে নানা হালকা চালের কথা বলছেন। এসব লেখকরা কে কিভাবে লেখক হয়ে উঠেছেন তা নিয়ে সাহিত্য মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এসব লেখকদের কেউ কেউ নানান তরিকায় দেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের নানা কৌশলে ভাঁজ- উপঢৌকন দিয়ে, কোথাও কোথাও অর্থকড়ি কিংবা অন্য কিছু সাপ্লাই দিয়ে, ঢাকা ক্লাব- গুলশান ক্লাবে পার্টির আয়োজন করে বাংলা একাডেমীসহ অন্যান্য পুরস্কার বাগিয়ে নিজেদেরকে বাংলা সাহিত্যের মানিক- তারাশংকর- বিভূতি ভাবছেন। এদের কেউ কেউ এখন নিজেদেরকে বাংলা সাহিত্যের অপরিহার্য শিরোমণি ধরে নিয়ে ঔদ্ধত্যের চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে হুংকার ছাড়ছেন, হুমায়ূন আহমেদ একই ফর্মেটে লিখেছেন- এসব লেখা কি পড়া যায়! আর তাঁকে নিয়ে এত হৈহল্লার কি আছে!
দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, এসব লেখক তাদের লেখার শুরুটাই করেছিলেন ‘একদিন যদি হুমায়ূন আহমেদ কিংবা তার ধারে-কাছের মতো লেখক হওয়া যায়-‘ এই ভাবনা থেকেই। এদের লেখার বিষয়ে, পরতে পরতে, ছত্রে ছত্রে হুমায়ুনীয় প্রভাব সুস্পষ্ট।
অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস তারাই আজ কথায় কথায় হুমায়ূন আহমেদকে অস্বীকার করছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে।
দুই
ভাঁজ-তরিকার এসব লেখকদের অনেককেই আমি চিনি। বিগত দিনে এদের অনেকের নিজের বলে কিছু ছিল না।
এরা একেকজন ছিল অনেকটা পাঠ্য বইয়ে পড়া ‘গনি মিয়া’র মতো গরীব কৃষক। এদের নিজের জমি ছিল না। এরা অন্যের জমিতে চাষবাস করত- কামলা দিত।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মহানুভবতা দিয়ে, ঔদার্য দিয়ে ‘গনি মিয়া’ জাতীয় অস্তিত্ব সংকটে বিলীন এসব তথাকথিত লেখক নাম ধারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর করুণা আর দয়া দাক্ষিণ্যে খেয়ে পড়ে এরা দিন গুজরান করেছেন তখন।
ইদানীং এজাতীয় লেখকেরা কথায় কথায় হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে নানা হালকা চালের কথা বলছেন। এসব লেখকরা কে কিভাবে লেখক হয়ে উঠেছেন তা নিয়ে সাহিত্য মহলে নানা প্রশ্ন রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এসব লেখকদের কেউ কেউ নানান তরিকায় দেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের নানা কৌশলে ভাঁজ- উপঢৌকন দিয়ে, কোথাও কোথাও অর্থকড়ি কিংবা অন্য কিছু সাপ্লাই দিয়ে, ঢাকা ক্লাব- গুলশান ক্লাবে পার্টির আয়োজন করে বাংলা একাডেমীসহ অন্যান্য পুরস্কার বাগিয়ে নিজেদেরকে বাংলা সাহিত্যের মানিক- তারাশংকর- বিভূতি ভাবছেন।
তিন
বত্রিশ বছর ধরে লেখালেখি, সাংবাদিকতা করার কারণে আমি বিভিন্ন সময় দেখেছি এসব লেখক কাম সাংবাদিক কাম অভিনেতা- নাট্যকার কাম তাত্ত্বিকরা হুমায়ূন আহমেদের মনোরঞ্জনে কিভাবে ফিল্মের কৌতুকাভিনেতাদের দারুণভাবে হার মানাতেন। কী করলে হুমায়ূন আহমেদ খুশি হবেন। কী বললে তিনি আনন্দ পাবেন- তা নিয়ে তারা দিনমান ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। ব্যাকুল থাকতেন।
আমি এদের অনেককেই দেখেছি নুহাশ পল্লীতে, স্যার এর ড্রইং রুমের আড্ডায় বিনে পয়সায় এটা সেটা এগিয়ে দেয়া, তাঁকে খুশি করার জন্যে বাজার করে দেয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া- আসার কাজ করে ধন্য হতেন।
এসব ফুট ফরমাশ খাটা’দের আমি নিজে দেখেছি। ফুট ফরমাশ খেটে ধন্য হতেন।
আর দিনের অধিকাংশ সময় হুমায়ুন- বন্দনায় মাতম করতেন তারা।
দিন বদলের পালায় আজ তাদের বহু বর্ণের ডানা গজিয়েছে।
চার
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যে এসব ‘গনি মিয়া’ টাইপের লেখকেরা চাগাড় দিয়ে উঠেছেন। বিনা উস্কানিতে এরা স্বরূপে আবির্ভূত হচ্ছেন। তারা নিজেদেরকে একেকজন হুমায়ূন আহমেদ কি তার চেয়েও ঢের বেশি লেখক বলে জ্ঞান করছেন। প্রচার করে বেড়াচ্ছেন তাদের বই নাকি হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে বেশি চলে। তারা টাকাপয়সা, পদ পদবীর প্রভাব খাটিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। তাদের কথাবার্তা, চলন বলনে এমন একটা ভাব ফুটে উঠছে যাতে করে মনে হয় এদেশে বুঝি কোনোকালে হুমায়ূন আহমেদ নামের কোনো লেখক ছিলেন না।
এসব লেখক কাম সাংবাদিক কাম অভিনেতা- নাট্যকার কাম তাত্ত্বিকরা হুমায়ূন আহমেদের মনোরঞ্জনে কিভাবে ফিল্মের কৌতুকাভিনেতাদের দারুণভাবে হার মানাতেন। কি করলে হুমায়ূন আহমেদ খুশি হবেন। কি বললে তিনি আনন্দ পাবেন- তা নিয়ে তারা দিনমান ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। ব্যাকুল থাকতেন।
আমি এদের অনেককেই দেখেছি নুহাশ পল্লীতে, স্যার এর ড্রইং রুমের আড্ডায় বিনে পয়সায় এটা সেটা এগিয়ে দেয়া, তাঁকে খুশি করার জন্যে বাজার করে দেয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া- আসার কাজ করে ধন্য হতেন।এসব ফুট ফরমাশ খাটা’দের আমি নিজে দেখেছি। ফুট ফরমাশ খেটে ধন্য হতেন।
পাঁচ
প্রকৃতি একদিন সবকিছুর বিচার করে- এমন কথা বহুবার আমি হুমায়ূন আহমেদের মুখেও শুনেছি।
এখন যারা পদ পদবী, চেয়ার আর গিরিঙ্গি’র জোরে এসব বলে বেড়াচ্ছেন, করে বেড়াচ্ছেন তাদের জন্য অনাগত দিন অপেক্ষা করছে।
তাঁর মৃত্যুর পর এদের কেউ কেউ আশা পোষণ করেছিলেন তারাই হয়ত হবেন হুমায়ূনের জায়গা দখল করে নেবেন। সাহিত্যে যে কেউ কারো জায়গা দখল করতে পারে না তা তারা বুঝতে পারেন নি। আর তারা এসব বুঝতেই বা পারবেন কোত্থেকে! কম বোঝা নাবালকের পক্ষে পৃথিবীর অনেক রহস্যকেই যেমন বোঝা সম্ভব না এদের বেলাতেও ঘটেছে তাই।
এখনো বইমেলায় লক্ষ লক্ষ পাঠক হুমায়ূন আহমেদের বই কিনতে দীর্ঘ লাইন দেয়। তাঁর বইয়ের বিক্রি এখনও বেশি। মৃত্যুর পর এতটুকুও দূরে সরে যান নি তিনি। বরং যতই দিন যাচ্ছে তাঁর লেখা আরও বহুমাত্রায় রঙিন হয়ে উঠছে নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে। এখানেই হুমায়ূন আহমেদের জাদু।
প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ- আপনার প্রয়াণ দিনে আপনার প্রতি অফুরান ভালোবাসা।
অপার শ্রদ্ধা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)