দেশব্যাপী এখন স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে বৃহৎ আয়োজন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চলছে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আজ সকাল থেকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন শুরু হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভোটার জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হলেও প্রথমবারের মত দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীকের নির্বাচন হওয়ায় অনেক জায়গায় সহিংসতার আশংকাও রয়েছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনে এধরণের সহিংসতায় বেশ কয়েকজন হতাহতের ঘটনা ঘটেছে । বহু মানুষ গুরুতর আহত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। দলীয় মনোনয়নে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য সরকারকে এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করতে হয়েছে । সরকারের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেককেই বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিসহ টিভি টকশোতে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি ! সংশোধিত আইনেই বর্তমানে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ বিষয়টি এখন সমালোচকদের গা-সওয়া হয়ে গেছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ তারা তা মেনে নিয়েছেন।
দীর্ঘ ভূমিকার পর এবার আসল কথায় আসি। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনায় ইউনিয়ন পরিষদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ তৃণমূল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে ইউনিয়ন পরিষদের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সরকারি সেবা বৃহত্তর মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। সুতরাং একটি গণতন্ত্র মনষ্ক কল্যাণকামী রাষ্ট্রে স্থানীয় সরকার বিশেষকরে ইউনিয়ন পরিষদ ব্যবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।
সরকার এ দিকটায় ওয়াকিবহাল আছে বলেই স্থানীয় সরকার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগি করার লক্ষ্যে এযাবৎ অনেক আইন ও আইনের সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বরাবরই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তা হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষাগত যোগ্যতার মত অত্যন্ত কাম্য একটি বিষয়কে অবজ্ঞা করে মূলতঃ শিক্ষার গুরুত্বকেই খাটো করা হয়েছে।
যেখানে শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচার করা হয়। রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতিতে এই ধারণাকে জাতির ভবিষ্যত কান্ডারিদের কাছে বিশ্বস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা যখন লক্ষণীয়, তখন নির্বাচনে প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিকে বাদ রাখার শান-ই-নযুল আমাদের জানতে হবে বৈকি ?
ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যানকে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। বাজেট ও উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি নির্বাচিত চেয়ারম্যানকে তার ইউনিয়নের বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব ও চারিত্রিক সার্টিফিকেট প্রদান করতে হয়। সাম্প্রতিককালে শিশুর জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদানের ক্ষমতাও ইউনিয়ন পরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। আমার নিজ বাড়িতে একাধারে ২৯ বছর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকায় পরিষদের কাজের ব্যাপ্তি ও তার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমি কিছুটা অবগত।
একজন চেয়ারম্যান যদি শিক্ষিত না হোন, তার পক্ষে ইউনিয়ন পরিষদ সুচারুভাবে পরিচালনা করা কঠিনই নয় অসম্ভব। শুধুমাত্র সচিবের দাপ্তরিক ও আক্ষরিক সহযোগিতায় একজন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সম্পন্ন হতে পারেনা। চেয়ারম্যানের নিজস্ব চিন্তাশক্তিকে ভিত্তি করে, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন করার জন্য চেয়ারম্যানকে শিক্ষিত হওয়া বাঞ্চনীয়। একই কথা প্রযোজ্য, পরিষদের নয়জন মেম্বার ও তিনজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের বেলায়।
কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । বলা যায়, প্রত্যাশার একেবারে উল্টোচিত্র ! অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদে যারা প্রার্থী কিংবা নির্বাচিত হোন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিই এতই হতাশাজনক যে এগুলো উল্লেখ করার মতো নয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যদি চতুর্থশ্রেণী-পঞ্চমশ্রেণী পাশ কিংবা বড়জোর আন্ডার মেট্রিক হোন, তার কাছে রাষ্ট্র কী পরিকল্পনা আশা করতে পারে ! প্রায় অশিক্ষিত এই মানুষটির পক্ষে জাতির মেরুদন্ড সোজা রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্র দেয় কি করে সেটাই প্রশ্ন ! ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের অবস্থা আরোও করুণ ! একেবারে অক্ষরজ্ঞানহীন মেম্বারদের দেখা মেলে ভুরিভুরি ! এদের কেউ রাতের গণশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কোনমতে নিজের নামটুকু ছেড়া-ভাংগা অক্ষরে লিখতে পারেন। প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে এধরনের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সংখ্যা অনেক !
গণতন্ত্র শিক্ষার প্রতিপক্ষ নয়। বরং সহায়ক শক্তি। আমাদের পরিহাস, এখানে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এর সুযোগে সমাজে অশিক্ষিতদের রাজনীতিতে যেমন প্রভাব বাড়ে, একইভাবে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের নেশায় তারা কালো টাকা ও পেশি শক্তির দাপট দেখা যায়। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, নেতৃত্বের জন্য শিক্ষার চেয়ে কালো টাকা ও পেশি শক্তিই বেশি প্রয়োজন। শিক্ষার গুরুত্ব তখনই দৃশ্যমান হবে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়ভার যাদের হাতে (নির্বাচনের মাধ্যমে) ন্যস্ত হয় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি তাদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষিত জাতি গঠনে শিক্ষিত নেতৃত্ব অপরিহার্য।
দেশে শিক্ষিতে হার এখন যথেষ্ট। স্থানীয় সরকারসহ দেশের প্রতিটি স্তরে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। আশাকরি, আগামী নির্বাচনের পূর্বেই সরকার এ দিকটায় নজর দিবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের উদ্দ্যোগ নিবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)