লেখক, উপস্থাপক ইকবাল খন্দকার। প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে ১০টি করে বই প্রকাশ করেন। গল্প, উপন্যাস, ভৌতিক, রহস্য, রম্যসহ পাঠকদের সব ধরনের বই উপহার দেন তিনি। এখন পর্যন্ত লিখেছেন ৬৩টি বই। ২০১৮ সালের বই মেলার জন্য প্রস্তুত করছেন ১০টি। মেলার প্রস্তুতিসহ নিজের লেখালেখি নিয়ে ইকবাল খন্দকার কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে।
কী কী বই প্রকাশ হচ্ছে এবারের মেলায়, সে গল্প শোনার আগে শুনতে চাই আপনার লেখালেখিতে আসার গল্প।
ইকবাল খন্দকার: ক্লাস এইটে পড়ার সময়। একদিন ক্ষেত থেকে ধান কেটে এনে উঠোনে রাখা হয়েছে। সেই নতুন ধানের গন্ধ নিয়ে ছড়া লিখেছিলাম। সেটাই আমার প্রথম লেখা। এরপর ক্লাস টেনে থাকতে লিখি একটি উপন্যাস। এইচএসসিতে পড়ার সময় দৈনিক ইনকেলাবের উপহার নামে একটি পাতায় লিখতে শুরু করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একে একে দেশের সব জাতীয় দৈনিকে লিখতে থাকি।প্রথম দিকে মূলত রম্য ম্যাগাজিনে লিখতাম। আলপিন, ভিমরুল, বিচ্ছু এসবে। লিখতে লিখতে একসময় পেশা হিসেবেও লেখাটাকেই বেছে নিলাম।
প্রতি বইমেলায় আপনার আট-দশটা করে বই বের হয়?
২০১৬ সালের বইমেলা থেকে দশটা করে বই বের হচ্ছে। সুস্থ থাকলে প্রতি বছর দশটা করে বই লিখব।
২০১৮ বইমেলায় আসবে যে ১০টি বই সেগুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে জানতে চাই।
বিদায় মা দ্বিতীয় খণ্ড:
গত মেলায় একটা বই লিখেছিলাম ‘বিদায় মা’। বইটা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। পাঠকরা আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রকাশক আগ্রহ দেখিয়েছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে এবার আসবে বিদায় মা দ্বিতীয় খণ্ড। বৃদ্ধা মাকে হাসপাতালে রাখার কথা বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে এক সন্তান। সেই মাকে অন্য একজন নিজ বাড়িতে নিয়ে যায়। নতুন বাসায় মা আভিজাত্যে বসবাস করলেও পুরনো একটা বালিশ কোলের কাছে নিয়ে ঘুমায়। কারণ এই বালিশ বানানো হয়েছে তার ছেলের পুরনো কাপড় দিয়ে। ওদিকে সন্তানের মনে অনুশোচনার জন্ম নেয়। কিন্তু সে এসে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পায় না। এমন জায়গায় শেষ হয়েছিল। এখান থেকেই শুরু হবে বিদায় মা এর দ্বিতীয় খণ্ডের গল্প। বইটি প্রকাশ করবে বর্ষা দুপুর।
রক্তাক্ত বদ্ধঘর:
এটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। দেশ পাবলিকেশন্স প্রকাশ করবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হৃদয় বিদারক একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাস। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সত্য হওয়া জরুরি। কেননা বানিয়েই যদি লিখলাম সেটা সাধারণ গল্প হয়ে গেল। সাধারণ উপন্যাস হয়ে গেল। মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এটা নিয়ে লিখতে গেলে তা সত্য হওয়াই উচিত। ঘটনা সত্য হলেও গল্পটাকে উপন্যাসে রূপ দেয়ার জন্য দশ শতাংশ কল্পনার আশ্রয় থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি বদ্ধঘরে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের গল্প। এবং সেই ঘর নারকীয় নৃশংসতা রক্তাক্ত হওয়ার গল্প।
ভূতুড়ে ডাকঘর:
কিশোর উপযোগী ভৌতিক বই। একটা গ্রামের ডাকঘর। সেখানে নানা রকম ভূতুড়ে ঘটনা ঘটে। এর পেছনে অনেক বড় কারণ আছে। খুবই মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বইটা শেষ হবে। বইটির প্রকাশক কথাপ্রকাশ।
রহস্যময় গুহা:
এটা রহস্য উপন্যাস। একটা গুহার সন্ধান পাওয়া যায়। সেটা নিয়েই কাহিনী। থ্রিলারের ধাঁচে রহস্য গল্প।এটিও প্রকাশ করবে কথাপ্রকাশ।
ছদ্মবেশী ঘাতক:
একটা এলাকায় ক্রমাগত খুন হতে থাকে। যখন খুনি ধরা পড়ে, দেখা যায় সে কাছেরই একজন। প্রশাসনের একজন বিশেষ কারণে ছদ্মবেশে এতগুলো খুন করেছে। এটি থ্রিলার বই। বের করছে পার্ল পাবলিকেশন্স।
দাঁত খোলা হাসি:
প্রতিবছর একটা করে রম্য বই লিখি। দশটা বই হলে একটা রম্য থাকে। প্রথম বছর বের হয়েছিল দাঁতভাঙ্গা হাসি, পরের বছর বস্তাভরা হাসি, ফাটাফাটি হাসি, জবরদস্ত হাসি, গুদাম ভরা হাসি, গড়াগড়ি হাসি, পেটফাটা হাসি নামে এখন পর্যন্ত রম্য সিরিজের সাতটা বই বের হয়েছে। ২০১৮ সালে আসবে দাঁত খোলা হাসি। প্রকাশ করবে সাহিত্যদেশ।
থ্রিলার উপন্যাস লাশবাড়ি অ্যাটাক, ভৌতিক উপন্যাস অভিশপ্ত সিন্দুকসহ ১০টি বই আশাকরি ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম দিনই পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারব।
লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন?
হ্যাঁ। পড়াশুনা শেষ করে চাকরি খুঁজিনি। আগে থেকেই পত্রিকায় লিখতাম। ফলে চাকরি না করেও ভালোভাবে চলতে পারছি। চাকরি করলে হয়তো এতোটা ভালো চলতে পারতাম না।
পাশাপাশি কী করছেন?
গান লিখি, স্ক্রিপ্ট লিখি। টেলিভিশনে উপস্থাপনা করি। নানারকম লেখালেখি করি।
উপস্থাপনায় আসার গল্পটা শুনতে চাই।
আগে নানা অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লিখতাম। ‘কে হতে চায় কোটিপতি’সহ অনেক অনেক অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লিখেছি। স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে দেখা গেল আমি লিখছি একভাবে। সেটা উপস্থাপিত হচ্ছে আরেক ভাবে। আমার চিন্তার সাথে উপস্থাপকের এক্সপ্রেশন মিলছে না। আমি যেভাবে দেখতে চাইছি সেভাবে পাচ্ছি না। একসময় নিজেই উপস্থাপনা শুরু করলাম। উপস্থাপনা এখনো চলছে। বিটিভিতে ‘শিল্পপ্রাঙ্গণ’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করছি। এশিয়ান টিভিতে চলছে ‘পণ্ডিতের পাঠশালা’। এছাড়া ঈদে স্পেশাল অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করে থাকি।
ফেব্রুয়ারি মাস ঘিরে লেখকদের আলাদা উত্তেজনা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকে। আপনার কী ধরণের প্রস্তুতি থাকে?
মেলার প্রথম দিন থেকেই বই যেন স্টলে পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করি। এ নিয়ে উত্তেজনা কাজ করে। এছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে টিভি অনুষ্ঠানের বইমেলা লাইভ করি। ব্যস্ত থাকতে হয়।
এখন পর্যন্ত ৬৩ টা বই লিখেছেন। বইয়ের নাম নির্বাচন নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয় না?
হ্যাঁ। অনেক দ্বিধায় পড়তে হয়। আমি নামটাকে বেশি প্রাধান্য দেই এই কারণে যে পাঠক প্রথম আকৃষ্ট হবে বইয়ের নাম দেখে। ভেতরে কী আছে সেটা বাসায় নিয়ে দেখবে। কিন্তু নাম পছন্দ না হলে তো বই বাসায়ই নেবে না। এজন্য নামটা অনেক প্রাধান্য নেই। এমনও হয় নাম ঠিক করতে পারছি না বলে লেখা শুরু করছি না। তবে বইয়ের নাম আমিই দেই। অনেককে দেখি ফেসবুকে সাত আটটা নাম দিয়ে ভোটাভুটির মতো করে। আমি মনে করি এটা খুব যৌক্তিক কাজ না। কারণ আমার লেখা বইয়ের জন্য কোন নামটা উপযুক্ত তা আমারচে ভালো আর কে জানবে?
প্রতি বছর দশজন করে মানুষ খুঁজে বের করতে হয় বই উৎসর্গ করতে। মাঝে মাঝে বিপদে পড়েন নিশ্চয়।
এটা তো খুবই বিপদের কথা। আসলে এত মানুষ পাওয়া মুশকিল। উৎসর্গের সময় মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন আজকে প্রকাশক বললেন, সবই ঠিকঠাক করলেন। উৎসর্গটা বাদ রাখলেন। দর্জিদের মতো কাজ করলেন। আমি বললাম, দর্জিদের মতো কী? তিনি বললেন, দর্জিরা জামার পুরো কাজ করে বোতাম ফেলে রাখে। আপনি বইয়ের সব কাজ করে উৎসর্গটা দিলেন না। কাজ আটকে রইলো। আমি আসলে কাকে উৎসর্গ করব ভেবে পাচ্ছিলাম। এই যন্ত্রণায় প্রতিবছর পড়ি।
গান লেখেন। আপনার লেখা একটি গান খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গান লেখার গল্পটা জানতে চাই।
লেখালেখির সব ক্ষেত্রে কাজ করতে চাই। সেই চাওয়া থেকেই গান লেখা। আমার প্রথম গান আসে আসিফ আকবরের ‘পানি নেই চোখে’ অ্যালবামে। গানের শিরোনাম ছিল ‘সব তারা নিভে যাক’। এরপর বেশি কিছু গান লিখেছি। তবে সবচে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেলাল খান ও পড়শির গাওয়া ‘ভালোবাসি হয়নি বলা তবু ভালোবাসি’ । মেঘলা দুপুরে কার নূপুরে গানটাও শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ভালোবাসি হয়নি বলা গানটা সারাদেশে ছড়িয়ে যায়।
আপনি গান লিখছেন, স্ক্রিপ্ট লিখছেন, ছোটদের জন্য লিখছেন, বড়দের জন্য লিখছেন। উপন্যাস, রহস্য, ভৌতিক, রম্যসহ সাহিত্যের সকল শাখায় বিরাজ করছেন। কোন ধারার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা অনুভব করেন? কী লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে আনন্দবোধ করেন।
কয়েকদিন আগে একজন প্রকাশক আমাকে বললেন, এইভাবে তো হবে না। আপনার একটা পরিচয় দাঁড় করাতে হবে। উপন্যাসিক, রহস্য লেখক, ভৌতিক লেখক, শিশু সাহিত্যিক, রম্য লেখক বা এমন নির্দিষ্ট একটি ধারায় আপনাকে আসতে হবে। না হলে পরিচয় তৈরি হবে না। জানতাম আমার উত্তরে উনি খুশি হবেন না। তারপরও বললাম, আমি চাই আমার সবগুলো কই হবে আলাদা। একটা থেকে অন্যটা অবশ্যই আলাদা। তখন আমার বই লেখা হয়েছিল ৪১ টা। বললাম, ৪১ টা বই কেন ৪১ রকম হলো না সেটা নিয়ে বরং আমার আক্ষেপ কাজ করে। আমি পারি লিখতে। আমি কেন একটা পরিচয়ে বসে থাকব। সাইন্সফিকশনে আমার আগ্রহ নেই বলে সাইন্সফিকশন লিখি না। পত্র-প্রত্রিকায় রম্য বেশি লিখি বলে অনেকে আমাকে রম্যলেখক পরিচয় দেন। আমি এতে বিব্রত বোধ করি। আসলে রম্য লেখার সুযোগ বেশি বলে সেটা লিখি। আমি মূলত সকল ধারার স্বাদ নিতে চাই। পরিচয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আপনার লেখা পড়লে বোঝা যায় চিন্তা যেমন গোছানো লেখার প্রতিও আপনি যত্নবান।
হ্যাঁ। আমি খুবই যত্ন নিয়ে লিখি। অনেকে আছেন যখন লেখার মাথায় যা আসে লিখে যান। পরে এডিট করেন। আমি তা করি না। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা লাইন পারফেক্ট না হলে পরের লাইনে যাই না। এমন হতে পারে লেখা শেষ হওয়ার আগেই আমি মারা গেছি। আমার অনুপস্থিতিতেও যেন ভুল কিছু পাঠকের হাতে না যায়। সব লেখার ক্ষেত্রেই আমি এমনটা করি।
কখনো মনে হয় লেখক জীবন সুন্দর?
আমার সবসময়ই মনে হয়। একজন ফিল্ম স্টার, একজন খেলোয়াড় এরা বয়স হলে ফর্মে থাকে না। কিন্তু লেখকের বয়স যত বাড়ে তার সম্মান তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মৃত্যুর পর সবার আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। লেখকের আলোচনা ও চাহিদা নতুন করে শুরু হয়।