শোকের মাস আগস্ট। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী। এ উপলক্ষে রাজধানীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শোভা পাচ্ছে হাজার হাজার পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড। কোনো কোনো সড়ক অথবা ফুটপাতে দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল তোরণ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এতসব আয়োজন।
তবে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কী এভাবে শ্রদ্ধা জানানো যায় এই মহান নেতাকে? এ দেখে মনে হয় বঙ্গবন্ধু উপলক্ষমাত্র, এর পেছনে নেতাদের অত্মপ্রচারটাই মূল লক্ষ্য।
প্রতি বছর আগস্ট আসলে দেশের বিভিন্ন স্থানেই দেখি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নেতাদের বড় বড় ছবি সম্বলিত ব্যানার, ফেস্টুন আর হাজার হাজার পোস্টার! তারা এভাবেই শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন জাতির জনকের প্রতি।
বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র বাংলা ও বাঙালির নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্ব সম্প্রদায়ের নেতা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্ব সভায় সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার আদর্শ থেকে আজকের এই প্রজন্ম যেন যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।
আজ যারা ব্যানার ফেস্টুনের মাঝে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আবদ্ধ করে রেখেছেন, তারা প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শটাকে কতটা লালন করছেন, সেটিও একবার ভাববার বিষয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাদের জানাটাও যে সীমিত, সেটিও অনুধাবন করা যায়। কেননা, তারা যদি প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুকে জানতেন, পড়তেন তাহলে পিতার আদর্শ ধারণ করে আত্মপ্রচার কেন্দ্রিক নেতা হতে পারতেন না। কেননা, বঙ্গবন্ধু কখনোই আত্মপ্রচার কেন্দ্রিক ছিলেন না। নির্লোভ একজন নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাহলে তার আদর্শের সৈনিক বলে আজ যারা দাবি করছেন, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ কি বিদ্যমান রয়েছে?
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও জীবনের দর্শন নতুন প্রজন্ম কতটা জানতে পারছে বা চর্চা করছে তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিশেষ করে আজকে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, তাদের অনেকের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুপস্থিত। তারা যে বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ, তা এদের জীবন ধারণ, রাজনীতির কলা-কৌশল দেখেই বোঝা যায়। তাদের রপ্ত করা উচিত বঙ্গবন্ধু কীভাবে কথা বলতেন, কীভাবে নেতৃত্ব দিতেন, কীভাবে একটি জাতীকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা নামক যে দুটি বই সাম্প্রতিক সময়ে আলোড়ন তৈরি করেছে, তা বেশী করে পড়া উচিত তরুণ প্রজন্মসহ ছাত্রনেতাদের।
এক অসাধারণ নেতৃত্বে মাধ্যমে ষাট দশকের শুরু দিকে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনে বঙ্গবন্ধু মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ওইসময় ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যদিয়ে বাঙালি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের উৎসাহে তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে গড়ে তোলা হয় সশস্ত্র সংগ্রামের একটি বিপ্লবী প্রক্রিয়া। সেটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস হিসেব খ্যাত ছিল।
সেসময় এ নিউক্লিয়াসের দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান (বর্তমান রাজনীতিতে রহস্য পুরুষ হিসেবে খ্যাত), আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এ সংগঠনের পরবর্তী নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমদ। নিউক্লিয়াসের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন। তৎকালীন সময়ে দেশব্যাপী শিক্ষা আন্দোলনসহ সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে নিউক্লিয়াসের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
একসময়কার নিউক্লিয়াস খ্যাত ছাত্রলীগকে বর্তমানে আমরা কোন অবস্থায় দেখছি! নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ! ব্যক্তিস্বার্থে জড়িয়ে তারা ভুলে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। অর্থ, প্রভাব আর প্রতিপত্তির নেশায় মত্ত হয়ে উঠছে অনেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে সেসব তথ্য উঠে এসছে।
ছাত্রলীগের গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’। ছাত্রলীগকে নিয়ে যারপরনাই গর্ব করতেন জাতির জনক। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাঙালির অনুপ্রেরণা হবে ছাত্রলীগ। মানুষের কথা বলবে ছাত্রলীগ। আদর্শভিত্তক, জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি করবে ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার রূপকল্প ২১ এবং ৪১-এর মর্মকথা ও বর্তমান সরকারের উন্নয়নের কথাগুলো তুলে ধরাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্যও সে দাবি রাখে। তবে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভাল করে উপলব্ধি করতে পারে না বলেই তারা বিভ্রান্তিতে ভুগছে। শেখ হাসিনার রূপকল্প অনুধাবন করতে হলে জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতির চর্চা ও প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরী।
শুধুমাত্র ছাত্রলীগ নয় আজকের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্যান্য সংগঠনও বঙ্গবন্ধুর আর্দশকে সেভাবে বুকে ধারণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শোক দিবসে চাঁদাবাজি করতে নিষেধ করে সাংসদসহ সিনিয়র নেতাদের চিঠি ও হুশিয়ারি দিতে হচ্ছে। শোক দিবসের পোস্টার-ফেস্টুনে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে ছাপিয়ে ছোট-বড় নেতাদের আত্মপ্রচারই বড় হয়ে উঠেছে। দল বা সংগঠন নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া এসব পোস্টার-ব্যানারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবিকে উপেক্ষা করে প্রচারকারীরা নিজের এবং তিনি যার অনুসারী তাদের ছবি বিশাল অংশে রাখছেন। এসব দেখে এটুকু অনুমেয় যে, এখানে তারা জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর থেকে নিজেদের প্রচারণাটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাপ্নিক এক নেতা। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্নে আদর্শ ছিল, দর্শন ছিল। যার কারণে স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ধীরে ধীরে শোষিত, বঞ্চিত, নীপিড়ত জাতিকে সংগঠিত করেছিলেন। জেল-জুলুম, নির্যাতন, হুলিয়া ও মৃত্যুর পরোয়ানা কোনো কিছুই তার সেই স্বপ্নের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। বর্তমান সময়ে নেতাদের জীবনদর্শন ও কর্মপ্রদ্ধতি হওয়া উচিত বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ও দূরদর্শীতা অনুযায়ী, যারা ব্যানারে ফেস্টুনে দাবি করেন তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং এই জাতিকে দেখিয়েছিলেন, তার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে হলে তার উত্তরসূরি রাজনীতিকদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম যাতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের আদর্শের অনুসারী হয়, তারা যেন এদেশের প্রকৃত ইতিহাস আয়ত্ব করে সুনাগরিক হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারে, সেজন্য বঙ্গবন্ধুর দর্শনভিত্তিক রাজনীতি চর্চা শুরু করতে হবে। বের হয়ে আসতে হবে আত্মপ্রচার কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে। প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। যাতে করে আবারও সবাই গেয়ে উঠতে পারে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণী বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’।