গত মাসের কোনো এক রাতে হঠাৎ করেই তিনটি বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে স্টকহোম। এই ঘটনা রীতিমতো অবাক করে শহরবাসীকে। কারণ বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও একেবারে দরজার পাশে ঘটে যায় তা।
শুধু এক রাতের এ ঘটনা নয়, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে দেশটির বোম নিস্ক্রিয় ইউনিটকে এ ধরনের ৯৭টি বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে কাজ করতে হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে।
ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্কও এখন অনেক বেশি। ২২ বছরের জোয়েল বলেন, আমি এখানে বড় হয়েছে এবং আমার মনে হচ্ছে পরিস্থিতি দিন দিন অনেক সহিংস হয়ে উঠছে।
বিস্ফোরণে জোয়েলের ঘরের সামনের দরজা উড়ে গেছে। আর জানালাগুলো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে হয়ে গেছে। এ কারণেই তার এমন উপলব্ধি।
এসব ঘটনার পেছনে কারা দায়ী?
২০১৭ সালের আগে দেশটিতে এ ধরনের ঘটনার কোনো অভিযোগ নেই। এরপর ২০১৮ সালে সেখানে ১৬২টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর চলতি বছরের গত দুই মাসে সুইডেনে প্রায় ৩০টির মতো ঘটনা ঘটেছে।
সুইডেনের ন্যাশনাল অপারেশন্স ডিপার্টমেন্টের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের প্রধান লিন্ডা এইচ স্ট্রাফ বলেন, বিভিন্ন অপরাধীচক্র এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রতিপক্ষ বা তাদের বন্ধু-আত্মীয়স্বজনদের ঘায়েলের জন্যই তারা এসব করছে।
তিনি বলেন, অপরাধীরা ভয়ানক ইমপ্রোভাইসড বিস্ফোরক ও হাত বোমার সাহায্যে এসব হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এটি ভয়াবহ অবস্থা, কিন্তু সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়, কারণ তারা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এসব অপরাধী চক্র কারা?
পুলিশের মতে, অনেক সময় একই অপরাধী চক্র একাধিক বন্দুক হামলার ঘটনায় জড়িত এবং এগুলোর সাথে মাদক পাচার জড়িত। সুইডেনে ২০১৮ সালে ৪৫টি রক্তক্ষয়ী বন্ধুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে, অথচ ২০১১ সালে এমন ঘটনা ঘটেছে ১৭টি।
তবে তারা কেনো বিস্ফোরক ব্যবহারও বাড়িয়েছে তার কারণ এখনো অজানা।
সুইডেনের পুলিশ সন্দেহভাজন বা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের রেকর্ড সংরক্ষণ বা প্রকাশ করে না।
এ বিষয়ে লিন্ডা এইচ স্ট্রাফ বলেন, অপরাধীরা সুইডেনেই বেড়ে উঠেছে। দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে সবাই উঠে এসেছে। অনেকেই সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসী।
রক্ষণশীল লেখক মীরা অক্ষয় বলেন, তারা একই এলাকার এবং অনেকটা একই মানসিকতার যা তাদের এক করতে সহায়তা করে। তারা ঠিক সুইডেনের সাথে অংশ হতে পারেননি। ভবিষ্যতে এই ঘটনা আরও বাড়বে এবং আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে।
তবে সুইডিস নাগরিক ব্রাডশ’র বিশ্বাস, মূলত অর্থনৈতিক কারণই প্রধানত অপরাধ বাড়ার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, আপনি যদি অভিবাসনবিরোধী হন তাহলে এটাকে এই দৃষ্টিতে দেখা সহজ যে ‘‘ওহ এটাতে অভিবাসীদের কাজ”। কিন্তু সমস্যাটি এর বাইরে।
কোন কোন এলাকায় ঘটছে এসব ঘটনা?
বেশিরভাগ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে স্টকহোম, গুটেনবার্গ ও মালমো শহরের শহরতলী এলাকায়, যেখানে মূলত নিম্ন আয়ের লোকজন বসবাস করে। চলতি মাসে মালমো শহরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
স্টকহোমের উত্তরে শহরতলীর একটি এলাকা ব্রম্মায় আবাসিক এলাকায় একটি বিস্ফোরণে একটি ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ ধ্বংস হয়ে যায়, জানালাগুলো উড়ে যায় ও গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।
আবার ঐতিহাসিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শহর লান্ড-এ একটি মুদি দোকানে হামলার ঘটনায় ২০ বছর বয়সী একজনকে চিকিৎসা দিতে হয়েছে।
লিনকোপিংয়ে ফ্ল্যাটে হামলার ঘটনায় ২৫ জন আহত হয়েছেন। সোডেরমালমে একসময় শ্রমজীবী মানুষ বসবাস করতেন যা পরে নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়।
সেখানেই যে ভবনে বিস্ফোরণ হয় তা ছিলো একটি স্কুলের কাছে। এ কাছের বসবাস করেন মালিন ব্রাডশো। তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই যখন পুলিশ আশেপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয় তখন আমি বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম, সত্যিই ভয় পেয়েছিলাম।
তবে এ ঘটনায় কাউকে আটক করা হয়নি এবং পুলিশও কোনো মন্তব্য করেনি।
এসব ঘটনায় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী?
পুলিশ বলছে তারা জড়িতদের খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছে কিন্তু ২০১৮ সালের ঘটনার প্রতি দশজনের একজনের শাস্তি হয়েছে।
ন্যাশনাল অপারেশন্স ডিপার্টমেন্ট পুলিশের সাথে একযোগে কাজ করার অঙ্গীকার করছে।সন্দেহভাজনদের খুঁজে পেতে আরও শক্তি বাড়ানোর কথা বলেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
কিন্তু সোডেরমালম শহরের অধিবাসী আন্দ্রে হেরডেন্ট বলেন, এসব ঘটনায় সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে।
এসব সন্ত্রাসী দলগুলোর সাথে বোঝাপড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের অপরাধ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত দল পাঠানো হয়েছে।
তাদের সাথে সুইডিশ মিলিটারি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয় আছে, যাদের আফ্রিকা ও আফগানিস্তানে বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে।
লিন্ডা এইচ স্ট্রাফ বলেন, সুইডেনে এ ধরনের ঘটনা নতুন এবং এজন্য আমরা সারা বিশ্ব থেকেই জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করছি।
তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞ আমির রোস্তামি এটিকে তুলনা করেছেন মেক্সিকোর পরিস্থিতির সাথে যেখানে গ্যাং কালচার মহামারির মতো। কিন্তু এটি নজিরবিহীন ঘটনা সেসব দেশের জন্য যেখানে কোনো যুদ্ধ নেই বা সন্ত্রাসের দীর্ঘ কোনো ইতিহাস নেই। যোগ করেন তিনি।