সংসদীয় বিতর্কে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন প্রয়াত সংসদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান। মাগুরায় জন্ম নেওয়া কৃতি এই মানুষটি চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদ অলংকৃত করেছিলেন। বরাবরই তিনি সংসদে জনগণের দাবি আদায়ে আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে উচ্চকিত থেকেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করেছেন। গণতন্ত্রের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। মহান সংসদে দাঁড়িয়ে মো. আছাদুজ্জামান একশতেরও বেশিবার শুধু বক্তব্যই উপস্থাপন করেছেন। তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য বরাবরই পার্লামেন্টকে আলোকিত করেছে। পার্লামেন্টারিয় ধারাকে শক্তিশালী করতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে।
৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর তার অকস্মাৎ অকাল প্রয়াণ সেসময় সবাইকে স্তম্ভিত না করে পারেনি। কৃতিমান এই বাকপটু রাজনীতিক মাত্র ৫৮ বছর বয়সে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চলে যান। ৯১ সালে শেষবারে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য ভবনের এক নম্বর ব্লকের ১০ নম্বর রুমে থাকতেন তিনি। ওখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিন শোকে বিহবল হয়ে পড়ে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ মাগুরার সমগ্র মানুষ। ঐদিন ঢাকা থেকে সামরিক হেলিক্যাপ্টারে করে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মাগুরাতে। জানাজা শেষে তাকে সমাহিত করা হয় মাগুরা ভায়না মোড়ে অবস্থিত পৌর গোরস্থানে। তার জনাযায় দল মত নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছিল তিনি কতোটা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার আগেই তার জীবনের অবসান ঘটে। দেখতে দেখতে তার প্রয়াণের ২৪টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও ‘ভ্যাটার্ন পার্লামেন্টারিয়ান’ হিসেবে খ্যাত আছাদুজ্জামান চির অমলিন হয়ে আছেন মানুষের হ্নদয়ে।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তীতে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের যেসব তৃণমূল রাজনীতিকগণ সংসদ এবং সংসদের বাইরে সবচেয়ে উচ্চকিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। এখনও সাংসদ আছাদুজ্জামান নামটি সংসদের ‘উচ্চকিত কন্ঠস্বর’ হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। প্রাণবন্ত বক্তব্য আর যুক্তি দিয়ে যিনি সবসময় জাতীয় সংসদে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হতেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ঘোর দুঃসময়েও জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, দুর্বার। বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে প্রতিবাদ করতে কখনই কুণ্ঠাবোধ করেননি। ৭৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চেয়েছেন নির্ভয়ে। ৯১ সালে চৌকষ এই রাজনীতিবিদ শেষবারের মতো মাগুরা ২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে বার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা পরাজিত হলেও মাগুরা ২ আসন থেকে আছাদুজ্জামান ৬১,০৬৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বিপরীতে বিএনপি থেকে মনোনীত প্রার্থী মে. জে. (অব.) মজিদ উল হক পান মাত্র ৩২২৬৬ ভোট।
মো. আছাদুজ্জামান ৭০ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টে বসার সুযোগ পান। ৭২ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি সংবিধান প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ৭৩ সালে মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও ৭৯ সালে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুর্দিনে ফের জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জননেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। উল্লেখ্য জিয়াউর রহমানের আমলে এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মাত্র ৩৯ জন সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। এরপর ৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেরও তিনি জয়ী হন। তবে রাজনীতির কারণে তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার হন এবং কারাবরণ করেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার বাড়িও কয়েক দফা লুটপাট করে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি অমানষিক নিযাতনের শিকার হন।
১৯৩৫ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন মাগুরা মহকুমার (মাগুরা জেলা) মহম্মদপুর থানার পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের মৌলভী জোকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মো. আছাদুজ্জামান। তাঁর পিতার নাম মরহুম মৌলভী হাবিবুর রহমান, মাতার নাম মরহুমা বেগম সামছুন্নাহার। তিনি ১৯৫৪ সালে মহম্মদপুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাশ করেন। ১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের এমএনএ প্রার্থী মরহুম আব্দুল খালেক সাহেবের ছাত্রকর্মী হিসাবে রাজনীতিতে যোগ দেন। একজন তরুণ রাজনীতিক এবং অনল বর্ষী বক্তা হিসাবে তৎকালীন মাগুরা ও নড়াইল মহকুমায় ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। চুয়ান্নতেই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন।
১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৮ সালে এবডো বিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৩ সালে পুনরুজ্জীবিত মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং দীর্ঘ দশ বছরের আইয়ুবের স্বৈর-সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন মাগুরার সম্মুখসারির নেতাদের অন্যতম। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রথমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা মহকুমা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক, মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক হিসাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নে তার গৌরবদীপ্ত ভূমিকা ছিল। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয়ভাবে ঐ পরিষদের তরুণ ও শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবে পুরস্কৃত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে প্রতিবাদে তিনি ও তার অনুসারীরা মাগুরায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং মাগুরা সদর থানা দখল করে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে পুনরুজ্জীবীত আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হলে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ঐ পদে বহাল ছিলেন। জেনারেল জিয়ার সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন মাগুরার প্রধান পুরুষ। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে মাগুরার প্রধান নেতা হিসাবে নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে তার ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার পর ঐ বছর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের সচিব নিযুক্ত হন। ৮৬ সালে পার্লামেন্টে দেওয়া শেখ হাসিনার প্রথম উপস্থাপিত বক্তব্য তিনিই চূড়ান্ত করেছিলেন।
আছাদুজ্জামান ছিলেন চৌকষ, বাকপটু, দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি সর্বদাই গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে তথ্য-উপাত্তের চমৎকার সমাহারে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। যুক্তির বাইরে তিনি কখনই যেতেন না। বরাবরই তাই রাজনৈতিক যুক্তির সৌন্দর্য দিয়েই তিনি প্রতিপক্ষের সবকিছুর জবাব দিতেন। পার্লামেন্টারিয়ান কোড অফ কন্ডাক্ট তিনি কখনই ভঙ্গ করেননি। এ কারণেই স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি একজন দক্ষ সৃষ্টিশীল পার্লামেন্টারিয়ানের স্বীকৃতি পান। মুজিব আদর্শের এই সৈনিক যতদিন বেঁচে ছিলেন দেশ এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই এ দেশের অজপাড়া গাঁয়ে জন্ম নেওয়া এই রাজনীতিক তৃণমূল থেকে উঠে এসে যেভাবে ন্যাশনাল পার্লামেন্ট আলোকিত করেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তা অমলিন হয়ে থাকবে চিরকাল। এমন বাকপটু পার্লামেন্টারিয়ান আজীবনই আমাদের অহংকারের বড় এক উপাদান। আর তাই এখনও এই কণ্ঠস্বর আমাদের মনকে নাড়া দেয়। তার প্রাণময় বক্তব্য, যুক্তি, উচ্চকিত কণ্ঠস্বর সংসদকে কেবলই শোভিত ও সৌন্দর্যময় করেছিল। পার্লামেন্টের শিক্ষক হিসেবে এখনও অনেকেই প্রয়াত সাংসদ আছাদুজ্জামানকে স্মরণ ও সমীহ করেন। গতবছর মো. আছাদুজ্জামানের স্মরণসভায় দাঁড়িয়ে সে কথাই বলেছিলেন বর্তমান সংসদের ডেপুটি স্পীকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)