‘ভুবন সোম’ ১৯৬৯ সালে নির্মিত মৃণাল সেনের প্রথম ব্যবসা সফল ছবি। বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে এবং ভারতীয় ফিল্ম ফাইন্যান্স করপোরেশনের অর্থায়নে এটি নির্মিত হয়। এই ছবিটি মৃণাল সেনকে দেশে এবং বিদেশে পরিচালক হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। ছবিটি হিন্দি ভাষায় রচিত হয়েছে যদিও মাঝে মাঝে বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখা যায়।
এই ছবিতেই সেন প্রথমবারের মতো কনভেনশনাল সিনেমার ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে সিনেমার ফর্ম নিয়ে নিজের মনের মতো খেলা করেছেন। এখানে যে কৌশলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে তা সাধারণত তখনকার ইউরোপিয়ান আর্ট সিনেমা যেমন এন্তোনিওনি, জ্যাঁ লুক গদার, বার্গম্যান, ফেদেরিকো ফেলিনি নামক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সিনেমায় দেখা যেতো।
এই ধারার সিনেমায় হলিউডের সচরাচর হিরো-ভিলেন, কাহিনীর শুরু-বিস্তার-ক্লাইমেক্স, ভালোর জয় খারাপের পতন, গৎবাধা ক্যামেরা শর্ট ইত্যাদির মাধ্যমে দর্শককে নিষ্ক্রিয় রেখে নিছক বিনোদন জোগানোর ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে ছবি তৈরি করা হতো।
আর্ট ঘরানার সিনেমায় সাধারণত পরিচালকের নিজস্ব দর্শন, ধ্যান ধারণা প্রাধান্য পায় এবং তার একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। ক্যামেরা এখানে ব্যক্তিমানুষ, তার একাকিত্ব, মানসিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদিকে ঘিরে আবর্তিত হয়। মৃণাল সেনের এই ‘ভুবন সোম’ চলচ্চিত্রে এসবই আমরা দেখতে পাই। এখানে কোনো ইয়াং আকর্ষণীয় হিরো নেই, আছেন পঞ্চাশোর্ধ এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি, কোনো গান নেই, আছে কিছু চমৎকার সুর, কোনো রমরমা জাঁকজমকপূর্ণ কাহিনী নেই, আছে শুধু রোজকার নিয়ম ভেঙ্গে ঘর ছেড়ে বাইরে বের হওয়া এক মধ্যবয়সী লোকের একদিনের অভিযানের বর্ণনা, আছে কিছু নৈতিকতাহীন মানুষের সমালোচনা।
সিনেমার শুরুতেই আমরা একটি ফ্রিজ শটে এই সিনেমার মূল চরিত্র ভুবন সোমের একটি ছবি দেখি। এরপরেই আমরা দেখতে পাই রেলওয়ের দুজন কর্মচারীর মধ্যে সোম সাহেব নামের একজন সম্পর্কে কথা বলতে, যার ওইদিন রেলস্টেশনে আসার কথা এবং যে কিনা তাদের একজনকে ঘুষ নেয়ার দায়ে বরখাস্ত করতে যাচ্ছে।
পরের সিক্যুয়েন্সেই আমরা শুনতে পাই ভুবেন সোমের কণ্ঠ। তিনি তার কর্মচারীদের সতর্ক করে বলছেন, এতো স্যার স্যার ডাকলে কাজ হবেনা, এত সম্মান দেখিয়ে কোনো লাভ নেই, তিনি পুরোনো ঢঙ্গের মানুষ, তার কাছে ‘ডিউটি ফার্স্ট, সেল্ফ লাস্ট’ ই মূলমন্ত্র। তাই সবাই যদি ঠিকঠাক তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাতেই তিনি খুশি হবেন। আর যদি কাজে ফাঁকি দেয় তো সেটা মেনে নেবেন না।
এরপর তাকে যাদভ প্যাটেল নামের একজন টিকেট কালেক্টরের খোঁজ করতে দেখা যায়। সে এসে তার সামনে দাঁড়ালে তাদের মধ্যে কোনো কথোপকথন হয়না। একে অপরকে দেখে তারা মনে মনে কী ভাবছে তাই শুনতে পাওয়া যায়। সোমের দৃশ্যটাকে ফ্রিজ করে দিয়ে সোম যাদভ সম্পর্কে কী ভাবছে তা বলতে শোনা যায়। এভাবে সাবজেক্টকে ফ্রিজ ফ্রেমে রেখে তার অভিব্যক্তি দর্শকের সামনে প্রকাশ করাকে ট্যাবলো ইফেক্ট বলে। এর মাধ্যমে দর্শককে সিনেমা নির্মাণ-পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করে বিভ্রম থেকে দর্শককে দূরে রাখা যায়।
সিনেমার এই প্রথম অংশটির মাধ্যমে আমরা তৎকালীন ব্যুরোক্র্যাটদের দুর্নীতিগ্রস্ত চিত্র এবং তাদের সমালোচনা দেখতে পাই। এরপরই ভুবন সোমকে ঘোড়ার গাড়ি চেপে কোথাও যেতে দেখা যায়। তখনই আমরা শুনতে পাই একজন ন্যরেটরের বর্ননা।
ন্যারেটর শুরু করে এভাবে- ‘এটা আপনারই ইচ্ছা তাকে আপনি ভালো বলবেন নাকি খারাপ তবে ভুবন সাহেব মানুষই এমন। অর্থাৎ পরিচালক এখানে কনভেনশনাল চিরকালীন ভালো হিরো প্রথা থেকে বের হয়ে এসেছেন এবং দর্শককেও এটা বলে দিচ্ছেন। তিনি সেই মানুষ যিনি অনিয়মের জন্য নিজের ছেলেকেও বরখাস্ত করেছেন বলে ন্যারেটর জানানোর সাথে সাথেই ভুবন সোমকে আবার ফ্রিজ ফ্রেম এ দেখা যায় এবং এই সময়ে ন্যারেটর নয় স্বয়ং সোমের বক্তব্য পাওয়া যায়। তাকে বলতে শোনা যায় এটা ছাড়া তার কোনো কিছু করার ছিলো না। কারন ছেলে কাজে ফাঁকি দিয়েছে শাস্তি তাকে পেতে হবে। এর মাধ্যমে পরিচালক সোমের নৈতিক মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ আর নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন এবং দর্শককে আবারোও সচেতনভাবে এটা উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছেন।
পরিচালকের দর্শন অপরাধী নিজের ছেলে হলেও শাস্তি তার প্রাপ্য। এছাড়া দর্শকের সামনে এটাও উন্মোচিত হয় আজকালকার যুগের ইয়াং সমাজের অধ:পতন। তরুণ যাদভ প্যাটেল ঘুষ নেয়, সোমের ইয়াং ছেলে তিনবার বিএ ফেল করা সেও দায়িত্বহীনভাবে অফিসের কাজ ফেলে কাউকে না বলে কোথাও চলে যায়। আর এ ধরণের কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি তিনি সহ্য করেন না। অনেককেই একারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন। এজন্য অফিসের কর্মচারীরা তাকে প্রকাশ্যে সম্মান করলেও তার পিছনে তাকে গালি দেয়।
এর পরেই ন্যারেটর বর্ননা করেন ভুবন সোমের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো এবং ক্যামেরা হঠাৎ করেই রাস্তা থেকে জাম্প কাট করে চলে যায়। অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ডের মধ্যে একাকি সোম সাহেব এর কাছে। চারপাশে নিস্তব্ধ অন্ধকারের মাঝে সে একা। কালো অন্ধকারের মধ্যে সোমের সাদা শার্ট পড়া তার চরম একাকীত্বকেই ফুটিয়ে তোলে। স্ত্রী মারা গেছেন। একমাত্র ছেলেও তার সাথে থাকেনা।
ভুবন সোম বাঙালি। রেলওয়ের মস্ত এক অফিসার। খুবই নীতিবান, একনিষ্ঠ, সৎ এবং কঠিন নিয়মনিষ্ঠ একজন মানুষ। প্রতিদিন একই রুটিন তার। অবিরত সিগারেট খেয়ে যান। ভুবন সোমের কর্মকাণ্ডের একটা অসাধারণ বর্ণনা দিতে পরিচালক দারুন একটা এনিমেশন ব্যাবহার করেছেন। ভুবন নেম প্লেট লাগানো একটা দোলায়মান দরজা, তার ভেতরে একটা টেবিলে বিস্তর ফাইল, একটা কলম একের পর এক ফাইলে সাইন করে যাচ্ছে, ফোনে রিং হচ্ছে, একটা সিগারেট জ্বলছে অথচ চেয়ারটা শুণ্য অর্থাৎ মানুষটি অদৃশ্য।
এনিমেশনে থাকা এ বিষয়গুলো দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অফিসার সোম সাহেবের প্রাত্যহিক ব্যস্ততা, তার নিত্য দিনের কাজ তুলে ধরা হয়েছে। এনিমেটেড দৃশ্যটি দেখে কারো বুঝতে বাকি থাকেনা যে চেয়ারটি সোম সাহেবের এবং তিনি সেখানে আছেন। অর্থাৎ বার বার সেন তার ছবিতে দর্শককে মনোযোগী করতে বিভিন্ন ধরণের সিনেমেটিক কৌশল ব্যবহার করেছেন।
এরপর আবার দেখা যায় সোম সাহেবের কথা বলতে বলতেই স্থির ফ্রেম এ স্বামী বিবেকানন্দের একটি ছবি এবং ন্যারেটর তাকে বলেন বাঙ্গাল। এরপর রবিঠাকুরকে সোনার বাঙ্গাল, বিখ্যাত চলচ্চিত্রাকার সত্যজিতকে দেখিয়ে মহান বাঙ্গাল এবং সর্বশেষ সঙ্গীতজ্ঞ রবিশংকরকে দেখিয়ে বিচিত্র বাঙ্গাল বলে বর্ণনা করেন যা কোনো সিনেমায় সাধারনত দেখা যায় না। এর পরই বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায় এবং অস্থির কলকাতায় আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভের সত্যিকার ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। হিন্দি ভাষায় রচিত এই সিনেমায় এই মহান বাঙালীদের বিশেষণের সাথে দেখানো ছিলো অবাঙালী দর্শকদের কাছে আমাদের সিনেমার বাঙালী হিরোকে বাঙালী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো।
এরপরের দৃশ্যে রিয়েল ডকুমেন্টারি দেখানোর অর্থ বিভিন্নভাবে করা যায়। কলকাতার চলমান অস্থির অবস্থা, বিক্ষোভ তার মনের মধ্যেও চলছে যা শান্ত করার জন্য সে আজ তার চার দেয়ালের বাইরে বেড়িয়েছে, দুই কলকাতার অস্থিরতা থেকে এক প্রত্যন্ত শান্ত নিরিবিলি গ্রামে চলে যাওয়া সোম সাহেবের অস্থির কঠিন চরিত্র থেকে সম্পুর্ণ পরিবর্তনকে বুঝাতে পারে, এও হতে পারে যে শহরের এই অস্থির কঠিন পরিস্থিতি সোম সাহেবের মত মানুষকে কিছুমাত্র বিচলিত করতে পারে না কিন্তু গ্রামের শান্ত পরিবেশ নিরীহ মানুষের একটু হাসি তাকে এবং তার মনকে বিগলিত করে দেয়।
আমরা জানি যে ভারতের যে প্রদেশগুলো আছে তাদের মধ্যে কলকাতা সেই ঔপনিবেসিক কাল থেকেই অন্যান্য স্টেটগুলো থেকে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। বিদেশি শাসনের যাতাকল থেকে মুক্তি পেতে যতো ধরণের আন্দোলন হয় তার অধিকাংশই এই কলকাতাকেন্দ্রীক ছিলো। বিদেশি শাসন চলে যাবার পরও দেশীয় নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ে ভারতীয় অন্যান্য জাতিদের থেকে বাঙালীরা এগিয়ে। এই সিনেমায় আমরা দেখি কলকাতার অস্থির পরিবেশ আর সোম যে এলাকায় শিকার করতে যায় ভীষণ রকমের শান্ত। এইভাবে ডায়লগ নয় বরং ফর্মের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দারুনভাবে অর্থ নির্মান করেছেন পরিচালক।
আর এই বাঙালীরই একজন সোম সাহেব। ২৫ বছর বাংলার বাইরে থাকার পরও যার বাঙালিয়ানা এখনও যায়নি। বহুদিনের একঘেয়েমী জীবনে অতিষ্ঠ এই সোম সাহেব একদিন ছুটি নিয়ে চার দেয়াল থেকে বের হয়ে আসেন বাইরে শিকারের উদ্দেশ্যে। এতক্ষণ ধরে বাঙালীর যে বর্ননা দেয়া হল এখানে এসে তা অনেকটা হাস্যরসের তৈরি করে। অনেকটা টিপিক্যাল বাঙালি ধরণের। সোম সাহেব দায়িত্বে অটল, কঠিন নিয়ম মেনে চলেন তাইতো প্রতিদিন তাকে শারীরিক অনুশীলন করতে দেখা যায় তাকে, অনেকটা পশ্চিমি ঢং এর পোশাক পরিচ্ছদ। তার শিকার করার শখ অথচ বাঘ ভাল্লুকে যাবেন না, পাখি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে চান। এসকল কিছু এর আগে বাঙালী সম্বন্ধে সেন যা দেখিয়েছেন তার সাখে কনট্রাস্ট করে একধরণে হিউমিলিয়েশন তৈরি করে।
পাখি শিকারে যাবার আগে দেখা যায় তিনি পাখি বিষয়ে বই পড়ছেন, ন্যারেটরের বর্ণনায় পাখি বিশেষজ্ঞ হয়ে যান। এখানে আবারও সেন তার বুদ্ধিদীপ্ত ফর্মিক চমক আনেন। অন্ধকার ব্যাকগ্রাউন্ডে সোমকে দেখা যায় পাখি বিষয়ক বই পড়তে আর সেই সঙ্গে তার মাথার চারপাশ দিয়ে এনিমেটেড অনেকগুলো পাখি উড়তে দেখা যায় হাস্যকর কিচিরমিচির শব্দে। এ যেন ভুবন সোম সাহেবের আশু পরিবর্তনের আগাম বার্তা দেয়। পাখিগুলো যেন তাকে উপহাস করছে তার অক্ষমতাকে আগে থেকেই বুঝতে পেরে।
আরো দেখা যায়, ভুবন সোম সেনাবেশে গরুর গাড়িতে করে তার নতুন অভিযানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। গাড়িয়ালের কণ্ঠে গান শোনা যায় “চাহে কই মুঝে জংলি কাহে, ক্যাহতাহে তো ক্যাহতা রেহে, হাম পেয়ার কি তুফানোমে গিড়ি হে তো হাম ক্যা কারে…..” সোমের পরিবর্তনের এটাও ছিলো এক আগাম সংকেত। এরপর গাড়িয়ালের সাথে নানাভাবে হাসি তামাসা ঝগড়া মস্করা (যা দর্শকের জন্য ব্যাপক হাস্যরসের খোরাক জন্ম দেয়) করতে করতে সেই পাখি শিকার করার গ্রামে পৌছায় সোম সাহেব।
তবে গ্রামের পথে ঢুকতেই তারা এক বন্য মহিষ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এর দ্বারাই প্রথম বারের মত আমরা সেই কঠিন মানুষটাকে ভয় পেতে দেখি এবং তার সীমবদ্ধতা বুঝতে পারি। শুধু তাই নয় এর একটু পরেই আমরা দেখতে পাই আসলে ওই মহিষটি বন্য নয় বরং এক সাদাসিধা সুন্দরী গ্রাম্য বালিকা তার পালনকর্ত্রী। এখানেই তার পরিচয় হয় গৌড়ি নামের এই গ্রাম্য বালিকার সাথে। তবে দেখা হলেও কথা তাদের মধ্যে তখনই হয় না।
গাড়িওয়ালা তাকে রাস্তা দেখিয়ে চলে গেলে সে আরোও একজনের সাথে পরিচিত হয়। সে দুরবীন দিয়ে পাখি খুঁজতে থাকলে এক কৃষকের সাথে দেখা হয় তার। তাকে সে বেশ গর্ব নিয়ে বলে সে পাখি শিকার করতে এসেছে। পাখি কোথায় পাওয়া যাবে তা বলে পথ দেখিয়ে দিতে বলে সে তাকে। কৃষকটি তাকে পথ দেখিয়ে দিলে সোম তাকে টাকা দিতে চায় টিপস হিসেবে। কিন্তু কৃষকটি হাজার অনুনয় সত্ত্বেও তা নেয় না। পরিচারক এখানে দেখিয়ে দিলেন ইনোসেন্স এর সাথে কোরাপশনের শার্প ডিভিশন।
এই ইনোসেন্স ই যে শেষ পর্যন্ত কঠিন সোম সাহেব কে পরিবর্তিত করে দেয় তা বোঝা যায়। আমরা দেখি এর পরের দৃশ্যেই আখ খেতের ভিতর দিয়ে যাবার সময় সোম সাহেব হারিয়ে যায়। সে যে সত্যিই এই একদিনের অভিযানে এসে চার দেয়ালের বাইরে যে বিশাল বৈচিত্রপূর্ণ দুনিয়া আছে তাতে হারিয়ে গেছে, ডুবে গেছে তা দর্শকের বোঝার বাকি থাকেনা।
অবশেষে আমরা সোম সাহেবকে পাখির দিকে তার বন্দুকের নল তাক করতে দেখি এবং তখনই সেই মিষ্টি দরদি কণ্ঠটি শুনতে পাই – এহ্, বিরি ফেকদো, নেহিতো পাঙ্খী উড় যায়েগা। আনাড়ি পাখি শিকারি তাই করে। এবং এর পর থেকে মেয়েটি তাকে শিকারে সব ধরণের সাহায্য করে। তার আরামের ব্যবস্থা করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যেয়ে, তাকে আদর যত্নে খাওয়ায় যা থেকে সে দীর্ঘ দিন থেকেই বঞ্চিত।
মেয়েটি হিন্দি বলতে পারে, তার সাথে টপকা দিয়ে কথা বলতে পারে, জিদ করে তাকে অনেককিছু করতে বাধ্য করে যা মেয়েটা ঢং করে করে না বা কোনো স্বার্থের জন্য করেনা, এটা তার সহজাত এবং চিরকালীন মাতৃত্বজনীত বৈশিষ্ট্য। তাই নির্মল এই প্রকৃতি এবং তার নিরীহ মানুষদের কাছে এসে সোম সাহেব আর আগের সোম সাহেব থাকেন না। আমরা দেখি সোম বার বার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তাকে দেখে।
এটাকে দীর্ঘদিন ধরে নারীসঙ্গ বঞ্চিত সোম সাহেবের যৌনাকাঙ্খা বলা যায় না, যদিও তার মধ্যে এক ধরণের অবদমিত নারীকাঙ্খা রয়েছে। কারণ আমরা দেখি সোম সাহেব যখন শিকারে আসছিলেন তখন রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো নারী মাথায় কলসি নিয়ে যাচ্ছিলো আর সেটা সোম সাহেব অতৃপ্ত চোখে বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছিলো। তার ঠোটে সিগারেটটা এমনভাবে ধরানো ছিলো যে তার ভেতরের পুরুষ যে জেগে গিয়েছিলো তা পরিচালক বেশ সুক্ষভাবেই দেখিয়েছেন। আবার বালুর চরে শিকারের সময় গৌড়ি যখন তার কাধে হাত রাখে তখন সে কেঁপে ওঠে, সোম সাহেবের হৃদয়ের মরুভূমিতে সেটা যেন ছিলো এক পসলা বৃষ্টি।
এই গ্রাম্যবালার প্রতি তার স্নেহ রয়েছে, ভালবাসা রয়েছে। তাইতো সে যখন জানতে পারে এই বালার বর তাদেরই একজন যাদেরকে অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত করতে যাচ্ছে, তখন তার অন্তর আত্মা কেপে উঠে। আমরা দেখি মেয়েটির ঘরে যাদভ প্যাটেলের ছবি দেখার সাথে সাথেই জাম্প কাট করে কমেরা চলে যায় রেলগাড়ি স্টার্ট হওয়ার দৃশ্যে। সেন এর মাধ্যমে সোম সাহেবের মানসিক অবস্থাটাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
মেয়েটি তাকে তার পোশাক পরিবর্তন করিয়ে পুরোদস্তুর গাঁউওয়ালা বানিয়ে ফেললে তা তাকে বিগলিত করে যেন সে এই মেয়ের কাছে একটি শিশু, নদীর চরে পাখি শিকার করতে গিয়ে মেয়েটি দৌড়ে দৌড়ে তাকে পাখির সন্ধান এনে দেয় তা তাকে বিমোহিত করে, বার বার শুট করার পরও শিকার করতে ব্যর্থ হলে মেয়েটি হাওয়া আর বালুর দোষ দিয়ে তাকে সান্তনা দিলে সে বিস্মিত হয়, মেয়েটি তাকে বুদ্ধি দিয়ে গাছ হয়ে ছদ্মবেশ নিতে বলে আর তার জন্য সে পুরো বালুচর পাড়ি দিয়ে পাশের গ্রাম থেকে গাছের ডাল পাতা নিয়ে আসে এবং শুট করার সময় তার পাশে গিয়ে তার কাধে হাত রাখে এটা তাকে উজ্জিবিত করে।
নিজের অজান্তেই এই প্রকৃতি তার ভেতরটাকে পরিবর্তিত করে দেয়।
অবশেষে সোম পাখিকে ঘায়েল করতে সক্ষম হয় তবে বন্দুকের গুলিতে নয়, শব্দে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই যে ভুবন সোম তার একদিনের অভিযান শেষ করে আনন্দ চিত্তে তার সেই চিরকালীন কঠিন নিয়মবদ্ধ জীবনে ফিরে আসেন। অভিযান শেষে ফিরে এসেই জীবনে প্রথমবারের মত একজন অনিয়মকারী যাদভ প্যাটেলকে ক্ষমা করে দেন। এটা তিনি করেন সেই গৌড়ির জন্য যার ইনোসেন্স ঔদার্য তার হৃদয়কে বিগলিত করেছে, যার শশুরবাড়ি যাওয়া হবে না স্বামীর চাকরি চলে গেলে। তাই সোম সাহেব এই পাপীকে ক্ষমা করেন।
বাইরের আনন্দ তিনি যে তার নিজের ইট কাঠের ঘরেও আনতে পেরেছেন সেই আনন্দ তাই যাদবকে ক্ষমা করে দেয়ার পর তার ঠোটেও ছুঁয়ে যায়। আমরা দেখি যাদব তার ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর নিজের মনেই সে তার হাসি আটকে রাখতে পারে না। তার চেয়ার থেকে সে উঠে পরে, আনন্দে তার রুমে যাখুশি তাই করে। টাই খুলে ফেলে দেয়, লাঠিকে বন্দুকের মত ব্যবহার করে দর্শকের দিকে তাক করে ধরে, গুনগুনিয়ে গান গায়, তার পেপার গুলো জমা করে তার উপর শুয়ে পড়ে। এটা তার ওই এক দিনের নিয়ম ভাঙার আনন্দ।
ভুবন সোম শুধু যাদবের চাকরিই রেখে দেয় না সে তাকে গৌড়ির গ্রামের নিকটস্থ রেল স্টেশনে বদলি করে দেয়। কিন্তু সিনেমার একেবার শেষে আমরা দেখি যাদভের কোনো পরিবর্তন হয়না এতে। সে গৌড়িকে চিঠি লিখে যানাচ্ছে তার চাকরি বেচে গেছে এবং তার পোস্ট এখন বড় জংশনে। আর বড় জংশনের মানে হল আরোও বেশি ইনকাম অর্থাৎ আরোও বেশি ঘুষ।
এখন প্রশ্ন আসে যে সেনের নির্মিত এই গৌড়ি শহরের ইট কাঠের দেয়ালের অভ্যন্তরে বসবাসকারী কঠিন নিয়মের মানুষ সোম সাহেবকে মুহূর্তের মধ্যে পরিবর্তন করে দেয় অথচ তার নিজের স্বামীকে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং আমরা দেখি যখন সোম তাকে যানায় যে যাদব ঘুষ নেয়, গৌড়ি তখন রেগে ওঠে এবং বলে এটাকে ঘুষ বলে না সে মুসাফিরদের আরামের ব্যবস্থা করে আর তার বিনিময়ে সে চায়ে পানিকা টাকা পেয়ে থাকে। হয়তো সেন নারীকে এতটা পাওয়ারফুল দেখতে চাননি। তিনি একদিকে নারীর দ্বারা পুরুষের ভেতরটাকে চুরমার হতে দেখিয়েছেন আবার সেই নারীর মুখেই বলিয়েছেন স্বামীর নাম মুখে নিতে হয় না। এটা বৈপরিত্ব তৈরি করে। কারণ আমরা গৌড়ির বাবার মুখে জানতে পারি যে গৌড়ি শহরে তার মামার বাড়িতে থেকে হিন্দি ভাষা শিখেছে, পড়াশুনা করেছে। আমরা সোমের বক্তব্যেও শুনি “আচ্ছা, লিখনাভি জানতিহে অর পড়নাভি জানতিহে, বড় তেজ হে লাড়কি..”। তাই সেন তার এই মুভিতে উভয়কূলই রক্ষা করেছেন।
সিনেমাটির সঙ্গীত নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। কমেডি ধাচের এই চলচ্চিত্রে বেশ দারুণভাবে সঙ্গীতের ব্যবহার করেছেন সেন। যখন যে মুহূর্ত সেটাকে ব্যক্ত করার জন্য তিনি সেই ধাচেরই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করেছেন। এগুলোর বেশিরভাগই ছিলো হাস্যরসে পরিপূর্ণ। যেমন সোম যখন শিকারে আসছিলো তখন রাস্তা দিয়ে অনেকগুলো নারী মাথায় কলসি নিয়ে যাচ্ছিলো আর সেটা সোম সাহেব তৃষ্ণার্ত চেখে দেখছিলো, তখন পাখির ডাকের সাথে মিলিয়ে একটা অসাধারণ মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছিলো।
সোমের শিকার করার বিভিন্ন পর্যায়ে দারুন সব ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে মজার হচ্ছে শিকার করার সময় একটা পাখি এবং গৌড়ির পায়ের আওয়াজের সাথে যে নন-ডাইজেস্টিক সাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে।
গৌড়ির চলার সাথে মিলিয়ে পিয়ানোর আওয়াজ আর পাখির চলার সাথে নুপুরের আওয়াজ মিলিয়ে দেয়া হয়েছে যা অসাধারণ একটা আবহ তৈরি করেছে। অর্থাৎ সেন এখানে সঙ্গীত এবং দৃশ্য মিলিয়ে দারুন দারুন পরিবেশ তৈরি করেছেন। সুরগুলো এবং দৃশ্যগুলো আলাদা করে দেখলে সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন অর্থ তৈরি করে আর যখন একসাথে দেয়া হয় দুটো মিলে তখন আরেকটি ভিন্ন অর্থ তৈরি করে।
আবার শিকার শেষ করে সোম যখন তার শিকার করা অক্ষত আহত হাসটিকে নিয়ে ফিরছিলো তখন তার সাথে ব্যআকগ্রাউন্ড মিউজিকটি ছিলো এমন যে, সত্যিকার অর্থে বীরের বেশে কেউ কোনো কিছু জয় করে আসলে সেই দৃশ্যে এটা ব্যবহার করা যায়। আর এখানে এই দৃশ্যে এটা ব্যবহার করার ফলে তা হিউমিলিয়েশন তৈরি করেছে।
তাছাড়া ভুবন সোম এমন একটি সিনেমা যেখানে ক্যামেরা শুধুমাত্র এর মূল চরিত্রকেই অনুসরণ করে যেমনটি আমরা দেখেছি জিম জারমোসের ডেড ম্যান কিংবা ডেভিড লিঞ্চের স্ট্রেইট স্টোরিতে। আর মানুষের মধ্যে যে দৃশ্যমান আনন্দের বিষয়টি কাজ করে অন্যের সম্পর্কে, অন্যের আবেগ অনুভূতিগুলো জানার যে টান, তা বেশ ভালোভাবেই পূরণ করে এই মুভিটি।
এই সিনেমার এতো নতুন উপাদানের সমাহার দর্শককে খুব সহজেই বিমোহিত করে এবং তা একারণেই হয়ে ওঠে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক।