বিশ্বে শিশু জন্মের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে জানিয়ে গবেষকরা বলছেন, এর প্রভাব মোকাবেলায় বেশিরভাগ দেশের কোনো প্রস্ততিই নেই।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জন্মহার কমে যাওয়ার অর্থ হলো এই শতাব্দী শেষে পৃথিবীতে জনসংখ্যা ব্যাপকহারে কমে যাবে।
২১০০ সাল নাগাদ স্পেন, জাপানসহ ২৩টি দেশের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। তাছাড়া এসব দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে।
আসলে কী ঘটছে?
জন্মহার কমতে থাকছে। এই জন্মহার ২.১ শতাংশের নীচে নেমে গেলে একটি দেশের জনসংখ্যা কমতে শুরু করে। ১৯৫০ সালে নারী প্রতি জন্মহার ছিলো ৪.৭ শতাংশ। অর্থাৎ নারীরা গড়ে ৪ জন বা তার বেশী সন্তান জন্ম দিতেন।

ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ‘ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স’ এর গবেষকরা দেখেছেন, ২০১৭ সালে এসে সেই জন্মহার অর্ধেকে নেমে গেছে।
ওই গবেষকরা একটি রিপোর্টে বলছেন, ২১০০ সাল নাগাদ জন্মহার হবে ১.৭ শতাংশ। তারা ধারণা করছেন, ২০১৬ সাল নাগাদ সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ৯শ ৭০ কোটিতে পৌঁছালেও ২০৬৪ সালে কমে হবে ৮শ ৭০ কোটি।
গবেষকদের একজন প্রফেসর ক্রিস্টোফার মারি বলেছেন, ‘বিশ্বের জনসংখ্যা কমার প্রবণতা অবশ্যই ভাববার বিষয়। এটার প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করা খুবই জটিল। তবে ধারণা করা যায়, এই প্রবণতার কারণে সমাজকে আমাদের ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষা, কর্মব্যস্ততা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতার কারণে নারীরা কম সন্তান জন্মদানে আগ্রহী হচ্ছেন। জন্মহার কমাকে সাফল্য বলেও বিবেচনা করা যায় নানাভাবে।’
কোন দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশী প্রভাব পড়বে?
ধারণা করা হচ্ছে, জাপানের জনসংখ্যা ‘পিক’ (সবচেয়ে বেশী) এ উঠেছিলো ২০১৭ সালে। সে বছর তাদের জনসংখ্যা ছিলো ১২ কোটি ৮০ লাখ। শতাব্দী শেষে তাদের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৩০ লাখের নীচে চলে যাবে। ইতালির অবস্থাও একই রকম। একই সময়ের মাপকাঠিতে তাদের জনসংখ্যা ৬ কোটি ১০ লাখ থেকে হবে ২ কোটি ৮০ লাখ। স্পেন, পর্তুগাল, থাইল্যান্ড এবং সাউথ কোরিয়াসহ ২৩টি দেশের জনসংখ্যা শতাব্দীশেষে অর্ধেকের নীচে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বে বর্তমানে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হলো চীন। তার জনসংখ্যার ‘পিক’ ধরা হচ্ছে একশ ৪০ কোটি। ২১০০ সালে দেশটির জনসংখ্যা কমে হবে ৭৩ কোটি ২০ লাখ। আর তার জায়গা দখল করবে ভারত।
যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার ‘পিক’ হলো ৭ কোটি ৫০ লাখ। এই জনসংখ্যা হবে ২০৬৩ সালে। তবে ২১০০ সালে ব্রিটিশ জনসংখ্যা আরও কমে হবে ৭ কোটি ১০ লাখ।
এই প্রবণতার কারণ কী?
ধারণা হতে পারে, জনসংখ্যা কমলে তো পরিবেশের জন্যই ভালো। কম মানুষে দূষণ কম হবে। বন উজাড় হবে না। কৃষি জমি অক্ষত থাকবে। কিন্তু প্রফেসর মারি বলছেন, ‘বেশী বয়সী অধিক জনসংখ্যা বিশ্বের জন্য মোটেই সুখের কথা নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেবে। বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সেই বিশ্বে অধিক হারে কর দেবে কোন জনগোষ্ঠী? বয়স্কদের স্বাস্থ্য সেবার জন্য কারা খরচ করবে? বয়স অনেক হওয়ার পরও কি তখনকার মানুষ চাকরি থেকে অবসর নিতে পারবে?’
এ সমস্যার সমাধান কী
যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ অভিবাসী জনগোষ্ঠী দিয়ে জনসংখ্যার অভাব পূরণ করেছে। তাতে জনসংখ্যা আরো কমেছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটা কোনো সমাধান নয়।
প্রফেসক মারি বলছেন, ‘এমন একটা সময় আসবে যখন অনেকগুলো দেশের সীমান্ত খুলে দিতে হতে পারে। কারণ জনসংখ্যার অভাব অভিবাসী দিয়েও পূরণ হবে না। মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে, পিতৃত্ব ছুটি দিয়ে, স্বাস্থ্যসেবা অবৈতনিক করে, নগদ অর্থ প্রণোদনা দিয়ে কোনো কোনো দেশ জনসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।’
সুইডেন তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১.৯ শতাংশ পর্যন্ত নিতে পেরেছে। তার জন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সিঙ্গাপুরে এখনো জন্মহার ১.৩ শতাংশের আশেপাশে।
প্রফেসর মারি আরও বলেছেন, ‘জনসংখ্যা কমতে থাকার বিষয়টি অনেকে কল্পনাও করতে পারেন না। বিষয়টি নিয়ে তারা হাসাহাসি করেন। তাদের মতে, জনসংখ্যা কমতে থাকলে তখন নারীরা বেশী সংখ্যায় সন্তান জন্ম দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যা কমতে থাকলে যেকোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর মানুষের ক্ষেত্রে বিষয়টি মাত্র কয়েক শতাব্দী পরের বাস্তবতা।’
জনসংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি গবেষকরা নারীদের বিষয়েও সতর্ক করেছেন। তাদের মতে, নারীদের শিক্ষার নিশ্চয়তা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সহজলভ্যতাও থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
‘ইউনিভারসিটি কলেজ লন্ডন’ এর অধ্যাপক ইব্রাহিম আবুবকর বলছেন, ‘যেসব পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে তার অর্ধেকও যদি বাস্তবে ঘটতে থাকে, তাহলে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে অভিবাসন দরকারি হয়ে পড়বে। কিন্তু সেটা সমস্যা সমাধানের উপায় নয়। সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিক নীতিমালায় মৌলিক পরিবর্তনের কথা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বিশ্বের কর্মক্ষম মানুষের বন্টন ব্যবস্থা খুব জরুরি হয়ে পড়বে।’