মহারাজা, তোমারে সেলাম!

বাঙালির ইচ্ছা তালিকায় থাকে বিষয়গুলো। ফেলুদার মত বুদ্ধি, লালমোহন বাবুর মত বন্ধু, তোপসের মত শেখার ইচ্ছে, উদয়ন পণ্ডিতের মত মেরুদণ্ড, গুপি-বাঘার মত সারল্য, তারিণীখুঁড়োর মত রসদীপ্ততা এবং তার মত প্রতিভা!

কার মত প্রতিভা? সত্যজিৎ রায় এর মত প্রতিভা। চলচ্চিত্রের মহারাজা। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্র গ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সংগীত পরিচালক কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

বুধবার তার ৯৭ তম জন্মদিন। মহারাজা, তোমারে সেলাম।

যাকে নিয়ে ‘রশোমন’ আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা যে দেখেনি, সে পৃথিবীতে বাস করেও চাঁদ-সূর্য দেখেনি।’ সত্যি তাই।

১৯২১ সালের এই দিনে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্ম সেখানে হলেও বাংলাদেশের সাথে ছিল তার রক্তের সম্পর্ক। সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষরা বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার বড় মাসুয়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।

১৯৩৬ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর দশমাস বয়সে তার তোলা ছবি বিদেশি পত্রিকা বয়েজ ওন পেপার-এ প্রথম পুরস্কার পায়। সে বছরই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন সত্যজিৎ। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনের কলা ভবনে ভর্তি হন সত্যজিৎ। বলা যায় এখানেই প্রখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসুর হাতে শিল্পী সত্যজিৎ-এর জন্ম ঘটে।

সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যাঁ রেনোয়ার সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে(দ্য বাইসাইকেল থিফ) দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।

চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন- এমন সিদ্ধান্ত তিনি যখন নিয়েছেন তখন তার কাছে প্রিয় গল্প ছিল বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’। অল্প কিছু টাকা যোগাড় করে ১৯৫২ সালে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের নামে ছবি নির্মাণে নামেন তিনি। তবে টাকার অভাবে সেটা কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করলে পথের পাঁচালীর কাজ শেষ হয়। প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চেনালেন সত্যজিৎ। একেবারে বাজিমাৎ যাকে তেমনটি করেছেন তিনি।

পরবর্তীতে সুনাম কুড়ানো সব ছবি নির্মাণ করেন তিনি। সব মিলে ৩৬টি সিনেমা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘অপরাজিত’, ‘পরশপাথর’, ‘জলসাঘর’, ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘তিনকন্যা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘অভিযান’, ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি সংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ প্রভৃতি।

‘পথের পাঁচালী’র অপু-দূর্গার রেলগাড়ি দেখা

পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে অপু ত্রয়ী বলা হয়, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে বহুল স্বীকৃত।

সত্যজিৎ রায় নির্মিত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী ’১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কারটি। ফ্রান্স এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া মিতেরা নিজে এসে সত্যজিৎত রায়কে লিজিয়ন অব অনার পুরস্কার দিয়ে গিয়েছেন।

‘অশনি সংকেত’ এ ববিতা। সঙ্গে সত্যজিৎ রায়

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মত্যুর কিছুদিন আগে তাকে দেওয়া হয় অস্কার পুরস্কার।

বাংলা সাহিত্যেও সত্যজিৎ রায় একটা বড় জায়গা দখল করে আছেন। বিশেষ করে শিশুতোষ গোয়েন্দা কাহিনী ফেলুদা সিরিজ প্রিয় আবালবৃদ্ধবণিতার। এছাড়া বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কুও সবার কাছেও দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি একাধিক ছোট গল্প লিখেছেন।

চলচ্চিত্রের ওপর লেখা সত্যজিৎ রায়ের প্রবন্ধের সংলনগুলো হল: আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস (১৯৭৬), বিষয় চলচ্চিত্র (১৯৮২), এবং একেই বলে শুটিং (১৯৭৯)।