রাত তখন প্রায় ১১টা, হঠাৎ হোয়াসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে টুং করে শব্দ। ঘুমাতে যাবার আগে শেষবারের মতো হোয়াসঅ্যাপ খুলে যা দেখলাম, তাতে ঘুম হারাম হবার জো! একটি গ্রাফিক্স পাঠিয়েছেন একজন বন্ধু, সেখানে দেখানো হয়েছে… একটি ছোট্ট নৌকার পেছনে মহামারীর ঢেউ, এরপরে মন্দা নামের আরেকটি ঢেউ, এর েপরেরটি অভাব নামের ঢেউ এবং সর্বশেষ ঢেউটির নাম অরাজকতা।
করোনাভাইরাসের এই সময়ে স্বাস্থ্য আর মৃত্যু চিন্তা নিয়েই ঘুমাতে যেতে হচ্ছে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষকে। চারিদিকে মৃত্যু আর আক্রান্তের খবরে পুরো বিশ্ববাসী মানসিক বিপর্যয়ের পিংপং বলের মতো এদিক ওদিক করছে, যেনো একটু ছুটে গেলেই সাধের পৃথিবী থেকে বিদায়। বাংলাদেশে বসেও সেই পরিস্থিতি পার করছি আমরা কোটি জনতা। স্বাধীনতা পরবর্তী নানা সময়ে নানা অনিশ্চয়তা আর অব্যবস্থা থাকলেও দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনের হুমকি স্বরূপ করোনাভাইরাসের মতো কোনো আপদ আমাদের সামনে আসেনি। বিচারিক ন্যায্যতা, নির্বাচন-ক্ষমতার রাজনীতি, নিরাপদ সড়ক, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে স্বল্প ও মাঝারি সময়ের বিপর্যয় হলেও সেগুলোর সময়ের সাথে সাথে একটা পর্যায়ে এসে সেগুলো থেমে গেছে। জনগণ বুঝেই গিয়েছিল, এগুলো জীবনেরই অংশ। তাই মেনে ও মানিয়ে নিয়ে চলছিল দেশের মানুষের জীবন।সেখানে মহামারী আকারে হাজির করোনাভাইরাস!
নিয়মতান্ত্রিক ও সাধারণ প্রক্রিয়ায় কিছু পাওয়া যাবে না বা যায় না, যেখানে যা থাকার কথা তা থাকে না… এটা দেশের একটি ওপেন সিক্রেট বাস্তবতা। তা এই মহামারীর সময়েও ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর পরামর্শের বন্যা চারিদিকে, সেগুলোর ভবিষ্যত বেশিরভাগ সময়ই উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো হয়ে থাকে, কাজেই সেসব বিষয়ে আলোচনা না করে তা নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছি। পৃথিবীর ইতিহাসে সব মহামারী যেভাবে তার গতিতে চলে গতি হারিয়ে থেমেছে, করোনাও হয়তো থামবে তার ধ্বংসলীলা শেষে। যদি মহামারীর ধাক্কা সহ্য করে এ যাত্রা টিকে যাই, তাহলে আমাদের ভাবতে হবে সামনের দিনগুলো নিয়ে…যা ওই গ্রাফিক্সে ফুটে উঠেছে।
মহামারীর পরে মন্দা
দেশের অর্থনীতিতে মন্দা আসবে বললে ভুল হবে, তা অনেক আগেই এসে গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় দুটি খাত, গার্মেন্টস ও প্রবাসী আয়। দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বলতে গেলে ভেঙে গেছে। জরুরি ছুটি ঘোষণার এক সপ্তাহও আমরা স্বাভাবিকভাবে সবকিছু টেনে নিয়ে যেতে পারি নি। প্রায় চল্লিশ বছর যে গার্মেন্টস খাতকে নানা ভর্তুকি আর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছিল তারাই সবার আগে কান্নাকাটি নয়তো পরোক্ষভাবে চাপ দিতে শুরু করে সরকারকে। সরকারও পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে অসহায়ের মতো তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবু রক্ষা পাক গার্মেন্টস সেক্টর। দেশে প্রচুর মেগা প্রকল্প চলার কারণে কেন্দ্রীয় রিজার্ভের ব্যবহার প্রতিনিয়ত ছিল, প্রবাসী আয় বন্ধ হবার কারণে সেখানেও সমস্যা দেখা দেবে খুব শীঘ্রই। এখানে কী অবস্থা দাঁড়াবে আর কিছু করার আছে কি নেই, তা হয়তো অর্থনীতিবিদরা ভাল বলতে পারবেন। ভরসা এখন দেশের আভ্যন্তরীণ কৃষিসহ নানা ছোট-মাঝারি খাত, তবে সেগুলোও আসলে উপরের ২ খাতের সঙ্গে জড়িত! মন্দার সময় জাতীয় গড় আয় (GDP), চাকরি, বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়, উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার, পারিবারিক আয়, ব্যবসায়িক লাভ এবং মুদ্রাস্ফীতি, এ সব কিছুই অনেক কমে যায়। জিডিপি’র হিসেব ছাড়া অন্যগুলো ইতিমধ্যে দেশে দেখা দিয়েছে। সবমিলিয়ে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার আগাম পূর্বাভাস ও বাস্তবতা অনুসারে, মন্দা আঘাত হানতে ও ক্ষতি করতে শুরু করেছে সারাবিশ্বসহ প্রাণের বাংলাদেশকে। সৃষ্টিকর্তার দয়ায় করোনা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে, কী যে হবে তা কেউ বলতে পারবো না।
মন্দার প্রভাবে অভাব
মন্দার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক ছুটি ঘোষণা শুরু করেছে, কেউ কেউ লে-অফ ঘোষণাও করেছে। আর দিন-সপ্তাহ-মাস ভিত্তিতে ব্যবসা করে কর্মীর বেতন দেয়ার পরে নিজেদের রোজগার করা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের অবস্থাতো বয়ান করার কিছু নেই। তাদের ব্যবসা না চলে কোনো প্রথাগত নিয়মে না আছে কোনো ব্যাংকিং সাপোর্ট, কাজেই মন্দা কাটিয়ে এদের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন। এছাড়া ভাসমান পেশার মানুষতো রয়েছেই। সবমিলিয়ে ধারাবাহিকভাবে বহু পরিবার বহু মানুষ মন্দার প্রভাবে ইতিমধ্যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি-বেসরকারি সামাজিক সাহায্যে এই অভাব যে সহজে পূরণ হবার নয়, তা বললে ভুল হবে না। তাছাড়া সেইসব সাহায্য প্রদান বা সার্বিক ব্যবস্থাপনার নেতিবাচক চিত্র (চালচুরি) শঙ্কিত করে তুলছে সবাইকে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অভাব আরও বাড়তে পারে। কাজেই এই অভাব মোকাবেলার জন্য শক্ত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রস্তুত হওয়া খুবই জরুরি।
অভাব থেকে অরাজকতা
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে মন্দা-অভাবের পথ ধরে নানা অরাজকতার চিত্র ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং ১৯৭৪ সালের বন্যা সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশে চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, হানাহানি বেড়ে গিয়েছিল। যা সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে সামলে উঠেছিল জাতি। এরপরে ২০০৮-০৯ সালের দিকে বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবও দেশে বেশ ভালভাবেই পড়েছিল। নানা সরকারি তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করলে তা সহজেই বোঝা যাবে। করোনা পরবর্তী সময়ে সেসবের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে। খেয়াল রাখা দরকার, সরকারী ত্রাণের ট্রাক থেকে খাবার কেড়ে নেবার মতো ঘটনাগুলো কিন্তু অভাবের তাড়না থেকেই হয়েছে।
পাঠক, উপরের লেখাগুলো পড়ে ঘাবড়ে গেলেন? ‘সব ঠিক আছে, কোনো সমস্যা নেই’ টাইপ মটিভেশনাল বক্তব্যে নিশ্চিন্ত থাকলে যেমন বিপদ, তেমনি উপরের এসব নেতিবাচক ইঙ্গিতে ঘাবড়ে গিয়ে হতাশ হলেও বিপদ। স্থানীয়ভাবে খাদ্য উৎপাদন, সঞ্চয়ে মনোযোগী হওয়া, অপচয় রোধসহ নানা ছোট-মাঝারি পদক্ষেপে আমাদের প্রস্তুত হবার পাশাপাশি, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নানা সদূর প্রসারী পরিকল্পনায় একসাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। আর তা না হলে একে একে সব ঢেউ আছড়ে পড়বে আমাদের উপরে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)