নিজের গায়ে না আসলে কোনো বিষয়ে নাকি বাঙালি কথা বলে না। এটা প্রবাদ। এর সত্য-মিথ্যা প্রমাণের বিষয়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। অন্যের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারলেও অন্যের বিষয়ে ‘নাক গলানো’র রীতি এই বঙ্গে প্রকট। সে ভিন্ন বিষয়। ডেঙ্গু বাংলাদেশে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে। মশা নিয়ে আর চুপ থাকা যায়নি। সেটা তো মানুষের শরীরেই বসেছে। এজন্য বোধহয় এ নিয়ে কথাটাও বেশি হয়েছে।
ডেঙ্গু নিয়ে কথা বলার কারণও আছে। মরণঘাতী হয়ে উঠেছিল এডিস মশার প্রকোপ। হায় হায় রব উঠেছিল। ডেঙ্গু দমনে ঢাকার দুই মেয়র গলদঘর্ম হয়েছেন। প্রথমে অস্বীকার বা দায় এড়ানোর মানসিকতা থাকলেও পরে ভয়াবহ পরিস্থিতি উপলব্ধি করেছেন মেয়রদ্বয়। ডেঙ্গু দমনে ওষুধ কেনা নিয়েও যে দুর্নীতি হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তা সামনে এসেছিল।
এরপর পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় অনেক জল গড়িয়েছে। ঢাকার ড্রেনও ফিরে গেছে আগের অবস্থায়। ঢাকায় নতুন মেয়রও নির্বাচিত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণে মেয়র পদে সরকারদলীয় প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ায় এমন পরিবর্তন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুললেও অভিযোগ খণ্ডন এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। পরাজিতদের নিয়ে অনেক কথাই লেখা হয়। ক্ষমতায় থাকাকালীন অনেক কথা হয়তো লেখা যায় না বলে। এটা এখানকার নিয়ম বললেও খুব বেশি একটা ভুল বলা হবে না।
তবে ডেঙ্গু যে মেয়র পদ ‘খেয়ে ফেলেছে’ সেটা বোঝা গেছে প্রধানমন্ত্রীর কথায়। দেশে এখন ডেঙ্গুর প্রকোপ তেমন একটা নেই। তবে ডেঙ্গু মৌসুম সন্নিকটে। তাই শঙ্কা রয়েছে। এজন্য তিনি ঢাকার নবনির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের সতর্ক করেছেন। তাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন: মশা যেন আপনার ভোট খেয়ে না ফেলে, সেটা নিশ্চয় আপনাকেই দেখতে হবে। মশা ক্ষুদ্র হলেও অনেক শক্তিশালী। এটা মাথায় রাখতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী অভিভাবক হিসেবে নবনির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলরদের পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকার অন্যতম বড় একটি সমস্যা যাতে তারা ভুলে না যান, প্রধানমন্ত্রী সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ভোট কি শুধু মশায় খায়? যানজট, দুর্নীতি, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা কি ভোট খায় না? খায়। প্রধানমন্ত্রী সেটারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তিনি বলেন: ডেঙ্গু একটি সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। কাজেই এখন থেকে নবনির্বাচিত মেয়র এবং কাউন্সিলরদের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। যে কোন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির জীবনে সবচেয়ে প্রয়োজন জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করা। কাজেই সেই আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে স্ব-স্ব দায়িত্ব আপনারা পালন করবেন, সেটাই আমরা চাই।
মেয়র কাউন্সিলররা জনগণের বিশ্বাস অর্জন করবেন কীভাবে? অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কাউন্সিলর মানেই এখন অনেক টাকা আর ক্ষমতার মালিক। মেয়র তো দূরের কথা। এটাই এখন বাস্তবতা। তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রতাপশালী নেতারাও এখন বেড়ালের মতো জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ আবার জেল হাজতে রয়েছেন। এসব সময়োপযোগী ব্যবস্থায় ভোট কমার বদলে বাড়ে। সেটা প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই বোঝেন। এখন ঢাকার মেয়র-কাউন্সিলরসহ দেশের সব জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা বুঝলেই হয়।
ঢাকার এখনকার কথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। এই শহরে যারা থাকেন, তারা জানেন শহরের প্রায় প্রতিটা অলিগলি কাটা। একদিন দু’দিন তো দূরের কথা, এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহও নয়, মাসের পর মাস রাস্তাগুলো কাটা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে কাটা হয়েছে। কিছু জায়গায় কাজ শেষ হলেও রাস্তা ঠিক করার যেন বালাই নেই। কারও কোনো দায় নেই। সেখান থেকে বাতাসে ধুলাবালি ছড়াক, আর চলার মতো অবস্থা না থাকুক; তাতে কার কী আসে যায়?
চীনের করোনা ভাইরাসের খবর আমরা ইতোমধ্যে সবাই জানি। ভাইরাস মোকাবিলায় সেখানে ৮-১০ দিনের মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন হয়েছে। আর আমাদের দায়িত্বশীলরা যেন মাসের পর মাস রাস্তাঘাটের বেহাল দশা দেখতে পছন্দ করেন। চীনের হাসপাতাল নির্মাণের সময় আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কৌতুকও ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশে হলে এমন সিদ্ধান্ত পাস হতে হতেই কয়েক মাস, আর পরবর্তীকালে কয়েক দফায় নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সময় পিছিয়ে খরচ বাড়ানোর বিষয়টি ওই কৌতুকের মূল বিষয়বস্তু ছিল। সেটা একেবারেই অমূলক নয়। রাস্তাঘাটের এই বেহাল দশাই যেন এর প্রমাণ।
ঢাকা যে মাঝে মাঝেই এখন দূষিত শহরের তালিকায় চ্যাম্পিয়ন হয় তাও বোধহয় দায়িত্বশীলরা দেখেন না। দেখলে নিশ্চয়ই এ বিষয়ে তাদের মাথাব্যাথা থাকতো। আর বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকার বিষয়টি নাহয় বাদই দেয়া যাক। বাদ দেয়ার কথা এজন্য বলছি যে, বসবাসের অনুপযোগী হলেও তো কোটি কোটি মানুষ এই শহরে বসবাস করছেন। এরপরও তো বিষয়টি ভোট খাওয়ার মতো নয়। ভোট খেয়ে ফেলতে পারলে তো এই শহর বসবাসের উপযোগী করার উদ্যোগ দৃশ্যমান হতো। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এবার প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশনা আর সতর্কতার পর জনপ্রতিনিধিরা কতোটা উদ্যোগী হন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
