ভারতের রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে হুলুস্থুল শুরু হয়েছে৷ যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশেও৷ মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে না বলে প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) উত্থাপনকালে তিনি ‘মুসলিমদের কেন নাগরিকত্ব দেয়া হবে’ এই প্রশ্ন তোলেন। বিরোধী শিবিরের তীব্র প্রতিবাদ উপেক্ষা করে রাজ্যসভায় এই বিলটি পাস হয়৷
বিলটিতে শুধু হিন্দু, শিখ, পার্সি, খ্রিস্টান, জৈন ও বৌদ্ধদের কেন সুবিধা দেয়া হলো, তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলে আসছিলেন বিরোধীরা। অভিযোগ মুসলিমদের সঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি করার উদ্দেশ্যেই বিলটি আনা হয়েছে। অমিত শাহ বলেন: গোটা দুনিয়া থেকেই যদি মুসলিমরা এসে এ দেশে নাগরিকত্ব চান, তাদের সবাইকে কি নাগরিকত্ব দিয়ে দেব? কী করে দেব। দেশ কীভাবে চলবে, এভাবে চলতে পারে না। কিন্তু কথা হলো গোটা দুনিয়া হতে মুসলিমরা ভারতে কেন আসবে?
অমিত শাহ আরও বলেন: প্রতিবেশী তিন দেশের রাষ্ট্রধর্ম হল ইসলাম। সেই কারণে শরণার্থী হিসেবে আসা তিন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে৷ এই বিলের বিরোধিতায় এখন উত্তাল পুরো ভারত।
বিলটিতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় পীড়নের কারণে এ দেশে শরণার্থী হিসেবে হিন্দু, পার্সি, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা আশ্রয় নিতে বাধ্য হলে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেখানে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা মুসলিমদের বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই। এই বিলকে সাম্প্রদায়িক ও সংবিধান পরিপন্থী বলেও সরব হয়েছেন বিরোধীরা।
ইতোমধ্যে মুম্বাইয়ের আইজি আবদুর রহমান এই বিলের প্রতিবাদ করে বলেন: আমি বিলের তীব্র বিরোধিতা করছি। এটি আমাদের সংবিধান পরিপন্থী। এই বিল পাশের প্রতিবাদে আমি চাকরি থেকে ইস্তফা দিচ্ছি৷ এই বিলের আরেকটি অমানবিক বৈষম্যের দিক হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,জৈন,পার্সি,শিখ ধর্মাবলম্বীরা যদি ভারতে ভিসার মেয়াদের অতিরিক্ত একদিন অবস্থান করেন তাহলে জরিমানা হবে ১০০ ভারতীয় রূপি। তবে সেই ব্যক্তি যদি মুসলিম হন তবে তাকে গুনতে হবে ২১,০০০ ভারতীয় রূপি।
পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হলে সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে ভারত, চীন ও মিয়ানমার কি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের খুব সুরক্ষা দিচ্ছে?এটা কি আসলে সংখ্যালঘু সুরক্ষা না হিন্দু সুরক্ষা? ভারত কি উগ্র হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে যাচ্ছে না? দেশে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে তারা কি অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কবর রচনা করতে চাচ্ছে, এটা তো তাদের দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষই বলছেন। এ নিয়ে খোদ ভারতই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে৷ আসামে কারফিউকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাস্তায় নেমেছে হাজারো ছাত্র জনতা। আন্দোলন তীব্র হচ্ছে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও পাঞ্জাবসহ বিভিন্ন রাজ্যে৷ গুলিতে নিহত হচ্ছে মানুষ৷
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে উত্তাল বিক্ষোভকারীরা রেলস্টেশনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পিটিয়ে আহত করছে রেলস্টেশনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের৷ বিজেপি আসলে ভারতকে ও এই উপমহাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে? কেন মানুষকে এমন সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা? সাম্প্রদায়িক ভাবনা যে একটি দলকে ও একজন মানুষকে কতটা অমানবিক করতে পারে তারা কি তারই একটা নজীর স্থাপন করলো না?
তিন দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের জবাব দিতে গিয়েই কি ভারত হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে? কিন্তু ভারত কি একমত বিজেপির এই সিদ্ধান্তে? পশ্চিম বঙ্গ আসাম, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন রাজ্য ছাড়িয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে খোদ দিল্লিতেও৷ নিশ্চুপ ও হতবাক হয়ে গেছে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ৷ বন্ধুভাবাপন্ন দেশটিই যখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সাথে তুলনা দেয়৷ তখন আর কী বলা যায়? অথচ এই পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করেই দেশটি স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ৷ তখন ভারত ছিল মিত্রের ভূমিকায়। একাত্তরে শরণার্থী হয়ে কেবল হিন্দুরা যায়নি, মুসলিমরাও গিয়েছিল। এখন বিজেপি কেন ভারতের অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে? যে বাংলাদেশ সকল ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে থাকবে বলত সেই বাংলাদেশ আজ হতভম্ব৷ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের ভারত সফর বাতিল করেছেন৷ এর পরপরই জাপানের প্রধানমন্ত্রীও তার ভারত সফর স্থগিত করেছেন। জাতিসংঘও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন৷ কয়েকটি রাজ্য নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল কার্যকর করতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
বিজেপি আসলে কী চাচ্ছে? তারা নিজদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়ন করছে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের জোরপূর্বক জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করছে। গুজরাটে মুসলিম নিধনে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭১ সালে ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল৷ ঘটনাটি আজকের এই বিজেপি যুগে হলে নিশ্চয়ই তারা কেবল বেছে বেছে হিন্দুদের আশ্রয় দিতো৷ বিজেপি নিজদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ালো এতে কী লাভ হবে বিজেপির? কী লাভ হবে ভারতের?
কংগ্রেস ভারত বাঁচাও আন্দোলনের ডাক দিয়েছে৷ সিপি (এম), সিপিআই, তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷ রাজ্যগুলো ছাড়িয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে খোদ দিল্লিতেও৷ রাজনীতির সাথে ধর্ম যুক্ত হলে যে কী সর্বনাশ হয় ভারত তাই দেখাচ্ছে৷ ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু এই তত্ত্ব কি এই দুই পাকিস্তানকে এক রাখতে পেরেছে? ভারতও কি তবে সেদিকেই যাচ্ছে? নইলে ভারত বাঁচাও আন্দোলনের প্রয়োজন হল কেন? নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে খোদ ভারত, জাতিসংঘসহ পৃথিবীর শান্তিকামী দেশ ও দেশের জনগণ৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে৷ বাংলাদেশকে অতিদ্রুত ভারত থেকে শিক্ষা নিতে হবে ও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে৷ ভারতের এই সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে বাংলাদেশ কী করবে সেটা দ্রুত ভাবতে হবে৷ এটাই আজকের সময়ের বাস্তবতা৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)