চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘বোতলবন্দি’ বিএনপির পরের ধাপ কী?

বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গেল। সংসদে যাবে না বলে সংসদেও গেল। তারা কত কথা বলল৷ কখনো বলল, ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠবে৷ কখনো বলল, অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়াবে৷ আবার কখনো বলল, ৩০ সেকেন্ডের আন্দোলনে সরকারের পতন হবে। কিন্তু এত কথার ভিড়ে কোনো কথাই আর টিকলো না৷ দলটির অভ্যন্তরে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷

নাটকীয়ভাবে চার সাংসদের শপথ নেয়া আর মহাসচিবের অস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস, দ্বিধাবিভক্তি ও এক চরম ধূম্রজালের৷ নির্বাচনে যাবো না, শপথ নেবো না, সংসদে যাবো না এসব কোনো সিদ্ধান্তেই আর স্থির থাকতে পারলো না তারা৷

সংসদ সদস্য পদে শপথ নেয়ার অপরাধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঠাকুরগাঁও-৩ থেকে নির্বাচিত জাহিদুর রহমান জাহিদকে বহিষ্কার করা হয়। বাকিরা শপথ নিলে তাদের পরিণতিও একই হবে বলা হয়৷ আবার ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের দলের বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ও সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান জাহিদকে গণসংবর্ধনাও দিয়েছে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।

গাড়ির শোভাযাত্রা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা সৈয়দপুর বিমানবন্দরে গিয়ে সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমানকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। জামায়াত নেতা বাবলু রশিদের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা এক গুচ্ছ ফুলের তোড়া নিয়ে মঞ্চে সংবর্ধনা দেয় বিএনপির এ সংসদ সদস্যকে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাহিদুর রহমান বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন বেগবান করতে এবং এলাকার গায়েবি মামলার আসামি সকল দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি হতে মুক্ত করতেই শপথ নিয়েছি৷

এই শপথ কেবল জাহিদুর রহমান পর্যন্তই থাকলো না৷ শেষ পর্যন্ত শপথ নিলেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত আরো চারজন সংসদ সদস্য। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার শেষ সময় ২৯ এপ্রিল রাত ৯টা। এই সময়ের মধ্যে শপথ নিতে বাকি থাকলেন কেবল দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শপথ গ্রহণের শেষসময়ে জাতীয় সংসদ ভবনে গিয়ে বিএনপির চার সংসদ সদস্যকেও শপথ নিতে দেখা গেল৷ শপথ নিলেন, বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মোশারফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে মো. হারুন অর রশীদ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। শপথ শেষে তারা বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তেই আমরা শপথ নিয়েছি।

এর আগে জাহিদ ছাড়াও শপথ নিয়েছেন গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। এসব শপথও বুঝি দলীয় সিদ্ধান্তেই৷

তবে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত কোনটা? শপথ নিতে যাওয়া নাকি না যাওয়া? একদিকে ঘটলো শপথ গ্রহণকারীদের বহিষ্কারের ঘটনা অন্যদিকে গণসংবর্ধনা৷

বিএনপি মহাসচিবও বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই এই শপথ গ্রহণ৷ তবে দলের মহাসচিব কেন শপথ নিলেন না? শপথ না নিলেও তিনি বলছেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যখন আমরা বলেছিলাম, সংসদে যাব না, ওই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। কারণ আমাদের পার্লামেন্টেও লড়াই করতে হবে। বাইরেও লড়াই করতে হবে।

এখন কথা হল তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত যদি সঠিক হয় তবে মির্জা ফখরুল কেন এ সিদ্ধান্তের দিকে গেলেন না? কেন শপথ নিলেন না তিনি?

১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল উথাপনের সময় সংসদে বিএনপির আসন ছিল ২০৭। আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মালেক) এর সংসদ সদস্য ছিল ৩৯ জন। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ (মিজান) এর সদস্য ছিল ২ জন।

অন্যান্যের মধ্যে সংসদে ছিলেন একতা পার্টির নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। সংসদে বিএনপির ছিল দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য। তাই তাদের সংবিধান সংশোধনে কোন অসুবিধা হয়নি।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেদিনে পাশ করা বিলে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ অনেকগুলো মানবতাবিরোধী ও নিপীড়নমূলক কালো আইনকে বৈধতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয় তখন। সংসদের বিরোধী দলের নেতা আসাদুজ্জামান খান এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করলেন।

এ নিয়ে বিরোধী দলকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হলো না। পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে একতা পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আজ সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে আপনারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রোধ করেছেন। ৭২ এর সংবিধানকে ছিন্নভিন্ন করছেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না, এই দিন আপনাদের থাকবে না। যে অন্যায় আজ আপনারা করছেন, সেই অন্যায়ের বিচার এই সংসদেই হবে। তখন আপনাদের পক্ষে কথা বলার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সংসদে আপনাদের দলের লোক খুঁজতে তখন দূরবীন লাগবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরও বলেছিলেন, ইতিহাস বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না, আপনাদেরকেও করবে না।

বাকেরগঞ্জ ১৪ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এডভোকেট সুধাংশু শেখর হালদার পয়েন্ট অব অর্ডারে দাড়িয়ে সেদিন বলেছিলেন, আজ আইনের শাসন এবং সংবিধানকে যেভাবে পদদলিত করা হলো একদিন ইতিহাস তার বিচার করবে। এই সংসদই একদিন আপনাদের অপকর্মের বিচার করবে। সেইদিন আপনাদের অনুশোচনা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সাড়ে চার লাখ নেতাকর্মীকে বিনা বিচারে আটক রেখেছেন। তাদের উপর নৃশংস নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিল তিল করে কারাগারে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করতে দেয়া হচ্ছে। এই পরিণতি একদিন আপনাদেরও হবে। তখন বুঝবেন, আজ কি ভুল করছেন।

আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বড়াই কইরেন না। ২০৭ শুধু ৭ হয়ে যাবে একদিন। তখন বুঝবেন ‘গণতন্ত্র’ কত দরকার। আজ আমাদের কথা বলতে দেন না। হত্যা করেন, জেলে পুরেন। আজ যদি এই বিল পাশ করেন তাহলে প্রতিহিংসার আগুনে আপনারাও পুরবেন।

১৯৭৯ সালের ২০৭ আসনের দলটি ২০১৮ তে মাত্র ৫ আসনে চলে এল৷ এই ৫ আসনও হল দ্বিধাবিভক্ত৷ দলটি হারালো তার দলীয় শৃংখলা৷ এমন পরিণতির কথা কি তারা ১৯৭৯ সালে ভেবেছিল? যে দলটি এতদিন এ সরকারকে অবৈধ সরকার ও সংসদকে অবৈধ সংসদ বলে আসছে আজ সে দলের এমপিরাই এ সংসদকে মহান সংসদ বলছে৷ এই সংসদে যোগদানে কি বিএনপির কোন লাভ হচ্ছে? হলে তা কী? শপথ নিয়ে তারা বহিষ্কৃতও হচ্ছে আবার সংবর্ধিতও হচ্ছে৷

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিলেন না আবার শপথকে সমর্থন করছেন৷ তবে কি ২০০৭ সালে যে মাইনাস টু সফল হলো না ২০১৮ তে এসে তারই আদলে সফল হতে চলল মাইনাস ওয়ান? দলটির পরস্পরবিরোধী ভূমিকা কি সেদিকেই যাচ্ছে না? কেউ কেউ বললেন বিএনপি সংসদে যোগদানের মধ্য দিয়ে বোতলবন্দি হয়ে গেল৷

গ্রামদেশে এখনও ঝাড়ফুঁক দিয়ে ভূতপ্রেতকে বোতলবন্দি করতে দেখা যায়৷ এসব বোতলবন্দিদের তখন নিজস্বতা বলতে কিছু থাকে না৷ কবিরাজের ইচ্ছা অনিচ্ছাতেই বোতলের ভেতরে তাদের বেঁচে থাকতে হয়৷ বিএনপি কি সেরকম একটি দলই হয়ে গেল না? যদি তাই হয় তবে এই বোতলবন্দির পরের ধাপ কী?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)