তিনদিন আগে মেয়েদের জন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেয়ার কথা জানিয়েছে তালেবান সরকার। এরই মধ্যে অল্প কিছু মেয়ে ক্যাম্পাসেও ফিরেছে। কিন্তু কান্দাহারে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে অজানা এক ভয়ের মধ্যে আছেন শিক্ষার্থী রানা’র।
তালেবানরা আফগানিস্তানের শাসনভার করেছে ছয় মাস হয়ে গেছে। ক্ষমতা দখল করেই তারা ঘোষণা করে, মেয়েরা উচ্চ নিতে পারবে না। এমনকি চাকরিও করতে পারবে না তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রানা বিবিসি অনলাইনকে বলেন, অনেক কিছু আগের মতোই স্বাভাবিক আছে। আগে যেভাবে চলতো সেভাবেই ছেলে-মেয়ে উভয়েই শ্রেণিকক্ষে বসে ক্লাস করছে।
তালেবান যোদ্ধার প্রহরায় শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করেছে লাঘমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলেমেয়েদের আলাদা রাখা হয়েছে।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
হেরাতের এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, মেয়েদেরকে মাত্র চার ঘণ্টার জন্য ক্যাম্পাসে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে ছেলেরা ২৪ ঘণ্টাই ক্যাম্পাসে থাকতে পারবে।
ক্ষমতার পালবদলের সময় থেকে তালেবানরা আফগান নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে নানান বিধিনিষেধ আরোপ করে। যেগুলোর বেশীরভাগই নারীদের বিপক্ষে। বিশ্বে আফগানিস্তানই একমাত্র দেশ যেখানে লিঙ্গভেদে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারিত হচ্ছে।
কলেজ পর্যায় থেকে উচ্চা শিক্ষায় মেয়েদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বিলুপ্ত করা হয় নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের চাকরিতেও নিষিদ্ধ করা হয়। হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। লাঘমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের ছাদে সার্বক্ষণিকভাবে একজন তালিবান প্রহরী মোতায়েন রাখা হয়েছে।
তালেবান সরকার বলছে, নারী অধিকার এবং নারী শিক্ষায় তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে দেশটির শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী বিধি মোতাবেক ছেলেমেয়েদের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা কারিকুলাম চালু করতে হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে।
‘আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো’
আফগানিস্তানের উষ্ম এলাকা লাঘমান, নাঙ্গারহার, কান্দাহার, নিমরোজ, ফারাহ এবং হেলমান্দ এই ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতি সপ্তাহে পাঠদান শুরু করেছে। যদিও রাজধানী কাবুলসহ শীতপ্রধান এলাকায় ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়ার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কাবুলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী হোদা বলেছেন, “অনেক মাস ধরে বাড়িতে বসে আছি। সেটা এক অর্থে ভাল সংবাদ। কিন্তু আমি জানি আমার অনেক শিক্ষক আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।”
তালেবান সরকার আসার পর আফগানিস্তানের কাবুল, হেরাত এবং বালখ এর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২২৯ জন অধ্যাপক অন্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গত ছয় মাস ধরে আফগানিস্তানের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবান বাহিনী যেবার প্রথম আফগানিস্তানের ক্ষমতা দক্ষল করে; সে সময় নারীরা শিক্ষাবঞ্চিত ছিলো। এ দফায় মেয়েদের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত করা হলেও তাদের মনে উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে।
“আমার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো। এখন শুনছি তালেবান সরকার মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আমি খুব আশাবাদী যে এ সরকার মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ চালু রাখবে।” থাখার প্রদেশের কলেজ শিক্ষার্থী মাহভাশ এভাবেই তার আশার কথা জানান।
‘আমি তো বাড়ি থেকেই বের হতে পারি না’
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, তালিবানরা হয়তো মেয়েদের পড়ারা জন্য কিছু কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দিবে। তালেবানরা মেয়েদের শিক্ষা উন্মুক্ত করে দিয়েছে এমন খবরে হতবাক কাবুলের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। তার মতে, রাজনীতিবিদ হওয়া বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তো নারীদের কাজ না। এসব কাজ কেবল পুরুষরাই করতে পারে।
একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা বিষয়ে পড়তে আগ্রহী অনেক শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। তারা আশঙ্কা করছে, তালেবান বাহিনী হয়তো এসব বিষয়ে পড়ার অনুমতি দিবে না।
অনলাইনে প্রত্যান্ত অঞ্চলের মেয়েদের শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে ‘অনলাইন জেরাত স্কুল’ চালু করেছেন অ্যাঙ্গেলা ঘায়ুর। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পড়াশুনার অনুমতিতে তিনিও সন্দেহ পোষণ করেছেন। যেসব মেয়ের স্কুলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের শিক্ষা দিতেই তরুণ বয়সে অ্যাঙ্গেলা ঘায়ুর শিক্ষকতা শুরু করেন।
“আমার বিশ্বাস তালেবান সরকার শরিয়া আইন চালু করবে এবং কালিকুলামে ইসলামী বিষয়গুলো যোগ করবে। মেয়েরা আর খেলাধুলা করতে পারবে না। তাদেরকে আরো বেশী বেশী শরীর ঢেকে চলতে হবে। মেয়েরা তাদের ইচ্ছামতো লেখাপড়া করতে পারবে না। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় ভয়। আমি সত্যিই ভীত। তাছাড়া উচ্চ শিক্ষা পেলেও তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারবে না। ”
হেরাত থেকে উচ্চশিক্ষা নেয়া সোরাইয়া বর্তমান বিধিনিষেধ এর কারণে চাকরিতে ঢুকতে পারছেন না। তিনি বলেন, “আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। তারা বলছে মেয়েদের চাকরি করা উচিত না।”
আন্তর্জাতিক চাপ
জানুয়ারি মাসে নরওয়েতে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তালেবানদের বৈঠকের ফলশ্রুতিতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য পেতে এবং বিদেশে বাজেয়াপ্ত সম্পদ ব্যবহারের উপর আরোপিত স্থাগিতাদেশে প্রত্যাহারে নারীদের জীবনমান উন্নয়নের শর্ত জুড়ে দেয়া হয় ওই সম্মেলনে।
বিদেশে বাজেয়াপ্ত সম্পদ ব্যাবহারের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে আফগানিস্তানে সাধারণ মানুষের জীবন পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। গত কয়েক দশক ধরে এমনিতেই আফগান নাগরিকদের জীবন মানের অবনতি ঘটছিলো।
মাজার-ই শরিফের এক মেডিকেল শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা না খেয়ে আছি। আমার বাবা আগের সরকারের চাকুরে ছিলেন। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আমার বাবার চাকরি নেই। আমাদের ঘরে কোনো খাবার নেই। পড়তে হলে আমার বই কেনা দরকার। কিন্তু আমাদের কাছে কোন টাকা নেই।”
আফগান মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার পথ সুগম নয়। যারা উচ্চা শিক্ষায় ফিরতে চাচ্ছে তারা মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করেছে। তারা আসলেই শিক্ষা সম্পন্ন করতে সে বিষয়ে নিশ্চিত না।
তাখার এক শিক্ষার্থী বলেছেন, “আমাদের লেখাপড়ার অনেক সময় অপচয় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে শুনে আমি খুশি। তবে তাদের আরোপিত নতুন নতুন বিধিনিষেধ মেনে নিয়ে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে। সেসব বিধিনিষেধের অনেক কিছুই আমার জন্য অস্বস্তিকর। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত আমাদের সঙ্গে বৈধ পুরুষ সঙ্গী থাকতে হবে।”
শিক্ষক পাশতানা দুররানি কান্দাহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল চালু করেছিলেন। তালেবান বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর তিনি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন।
তিনি বলছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার বিষয়টিতে শান্তি প্রচেষ্টার প্রয়াস বলে মনে হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানানো উচিত। কিন্তু অনেক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পর আফগানিস্তান থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে। তাদের জন্য আমার দুঃখ লাগছে।”