প্যারিসে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা। সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেওয়া ওই হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হন। পুলিশের গুলি ও আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে আট সন্ত্রাসীও।
প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন বেঞ্জামিন কাজেনভোস। ঘটনার সময় বাটাক্লাঁ কনসার্ট হলে ভেতর থেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট করতে থাকেন। সেখানে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা একজন একজন করে জবাই করছে। তারা আসলে পুরো বিশ্বকেই জবাই করছে।
বেঞ্জামিন আরো বলেন, শুধু বেঁচে আছি, তবে সর্বত্র মৃতদেহ।
হল রুমের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মার্ক করপিয়াস বলেন, হামলার জায়গাটা দেখতে ছিলো যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। সব জায়গা রক্ত আর মৃতদেহ।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জুলিয়ান পায়ার্সি। গুলি চলার সময় তিনি বাটাক্লাঁ কনসার্ট হলে ছিলেন। ইউরোপ ‘রেডিও রেডিও ওয়ান’কে তিনি বলেন, দুই থেকে তিনজন বন্দুকধারী কনসার্ট রুমের ভেতরে ঢোকে। হামলাকারীরা ছিলো খুবই তরুণ। তবে তারা মুখোশধারী ছিলো না। ভেতরে ঢুকেই তারা গুলি করতে শুরু করে।
জুলিয়ান আরো বলেন, ১০-১৫ মিনিট চলে গুলি। এর সর্বত্র ছিলো মৃতদেহ। সেই অবস্থা খুবই হৃদয় বিদারক।
সস্ত্রীক বাটাক্লাঁ কনসার্ট হলে উপস্থিত ছিলেন বেন গ্রান্ট। ফ্রেন্স ইনফোকে তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি চালায়। আমরা কোনো রকমে বেঁচে গেলেও সেখানে ছিলো রক্তের বন্যা। আমি সেখানে অনেক মৃতদেহ দেখেছি। পরে আর কিছু মনে করতে পারছি না।
স্টেট ডি ফ্রান্স স্টেডিয়ামে ফ্রান্স-জার্মানি ম্যাচ কাভার করছিলেন লিবারেশন পত্রিকার সাংবাদিক ভিনসেন্ট। তিনি বলেন, প্রথমে আমরা দুটি বড় বিস্ফোণের শব্দ শুনতে পাই। এরপর গ্যালারি থেকে নেমে সবাই মাঠের মধ্যে চলে যায়। বাইরে আসলে কি ঘটছে উদ্বিগ্ন দর্শকদের কেউ কিছু অনুমান করতে পারছিলো না।’
প্যারিসে যেসব স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তারই একটির কাছে, একটি কফির দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত চিত্র সিঁথি সাহাবুদ্দিন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, শুক্রবার এরকম স্থানে অনেক মানুষের ভিড় থাকে। হঠাৎ করেই সেখানে পুলিশের আনাগোনা দেখতে পান।
বাইরে গুলির শব্দ শোনা যেতে থাকে আর পুলিশ এসে কফির দোকানের দরজা আটকে দেয়।
তিনি আরো বলেন, গুলির শব্দ শুনে ভয়ে আমরা পেছনের দরজা দিয়ে একটি বাগানে গাছের নীচে একঘণ্টার মতো লুকিয়ে ছিলাম। পুলিশ বলেছে, তোমরা এখান থেকে নড়ো না, কারণ সন্ত্রাসীরা এখনো গুলি ছুড়ছে। সেখানে আমরা ৮০/৯০ জনের মতো লুকিয়ে ছিলাম।
সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী বলেন, এই প্রথমবারের মতো প্যারিসে আমরা এ ধরণের চিত্র দেখলাম যে, আমাদের মতো শত শত তরুণ বিভিন্ন গলিতে লুকিয়ে রয়েছে। তারা আস্তে আস্তে বেড়িয়ে গাড়ি ধরার চেষ্টা করছে। মেট্টো বন্ধ করে দেখা হয়েছে, রাস্তা রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড। চারদিকে শুধু পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স। শুক্রবার রাতে প্যারিস সরগরম থাকে। কিন্তু প্যারিসের আজকের মতো এরকম চিত্র আমি আর কখনোই দেখিনি, চারদিকেই নীরব, ভীতিকর একটি পরিবেশ।
প্যারিসের অন্য একটি এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম। তার বাসার ঠিক উল্টোদিকে একটি এলাকায় হামলা করে সন্ত্রাসীরা। তিনি বলেন, আমি ঘরে বসে ইন্টারনেটে কাজ করছিলাম। হঠাৎ প্রচুর মানুষের ছোটাছুটির শব্দ শুনতে পাই। হঠাৎ করে এরকম একটি পরিস্থিতি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। তখন অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে পাই।
রোডে দ্য শাও নামের সড়কের পাশে একটি রেস্তোরাঁ হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তার পাশেই একটি এশিয়ান রেস্তোরাঁ কাজ করেন বাংলাদেশে লাভলু বড়ুয়া।
তিনি বলেন, আমাদের রেস্তোরাঁর দুইশ গজ দূরেই, একটি ফরাসি রেস্তোরাঁয় টেরাসে (খোলা জায়গা) বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। সন্ত্রাসীরা সেটা লক্ষ্য করেই হামলা করে। টেরাসে বসে যারা খাচ্ছিল, তাদেরকে লক্ষ্য করেই তারা গুলি করতে শুরু করে।
গোলাগুলির শব্দ শুনে প্রথমে তারা ভেবেছিলেন, সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন হওয়ায় হয়তো কেউ আতশবাজি ফোটাচ্ছে। একটু পরে দেখতে পেলেন, সব রেস্তোরাঁর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে, তাদের রেস্তোরাঁর দরজাও বন্ধ করে দেয়া হয়।
লাভলু বড়ুয়া বলেন, জানালা দিয়ে আমরা অনেক লোকজনকে ছোটাছুটি করতে দেখতে পাই। কিছু পরে আমাদের একজন গ্রাহক সেখানে গিয়ে দেখতে পান, দশ-বারোজন মানুষ মাটিতে পড়ে রয়েছে।
মেট্টো চলাচল বন্ধ আর রাস্তাগুলো পুলিশ আটকে দেয়ায় প্রায় ৪৫ মিনিট হেটে তিনি বাসায় ফেরেন।