চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

নির্বাচন: গণতন্ত্রের পশ্চাদ্ধাবন!

দফায় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশে। সারা বছর ধরেই চলে নানাস্তরের নির্বাচন-বিশেষ করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর মধ্যে ইতিহাসের পরিষদ, নির্বাচনগুলিকে আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। বুঝে নিতে পারি নির্বাচনগুলি কেমন হলো, গণতন্ত্রইবা কেমন এগুলো?

অতি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নির্বাচন হয়ে গেল সম্ভাব্য দুই শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদে। এই নির্বাচন আগে ছিল পুরোপুরি নির্দলীয়। কোন প্রকার দলীয় মনোনয়ন নিতে হতো না। যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়াতেন তাঁরা কে কোন দল করেন বা না করেন ভোটাররা নিজেদের পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে আনতেন। যাঁরা চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হতেন তাঁদের মধ্যে খুব বেশী হলে ২০-২৫ ভাগ বা তার কম দুর্নীতির সাথে জড়িত হতেন।

Bkash July

সারাজীবন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে এমন চেয়ারম্যানও ছিল বেশ ভাল সংখ্যায়। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব না হলে আজীবন প্রতিটি নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া যে সম্ভব না তা বুঝতে আদৌ কোন কষ্ট হয় না। চেয়ারম্যান পদকে অত্যন্ত সম্মত পদ হিসেবে বিবেচনা করে যাঁরা সৎ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব তাঁরাই দাঁড়াতেন। এঁদের মধ্যে একজন নির্বাচিত হতেন।

তখন ইউনিয়ন অধিদফতরগুলির সম্মানী ভাতা ছিল অনুল্লেখযোগ্য। তবে ইউনিয়ন পরিষদগুলির সেক্রেটারি ছিলেন সরকারি বেতনভূক্ত এবং বদলিযোগ্য। এঁদের বেতন চেয়ারম্যান মেম্বারদের প্রাপ্ত ভাতার কয়েকগুন বেশী ছিল তা সত্ত্বেও সেক্রেটারিদেরকে দেখেছি চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরকে যথেষ্ট সম্মান করতে-সমীহ করতে।

Reneta June

ফলে ইউনিয়ন পরিষদগুলিতে কাজের বিষয়গুলি ছিল লক্ষ্যনীয়। উন্নয়ন কাজ তাঁরা যে খুব বেশী একটা করতে পারতেন না তা না। কারণটি হলো তহবিলের স্বল্পতা। ইউনিয়ন ট্যাক্স আদায় হতো অনেক কম গ্রামীন দরিদ্র মানুষের সংখ্যাধিক্য এর কারণ। তাই মাঝে মধ্যে তাগিদ দিলেও ইউনিয়ন ট্যাক্স আদায়ের জন্য চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তেমন পীড়াপীড়ি করতেন না।

হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ সরকার স্থানীয় এই সকল নির্বাচনেও জাতীয় সংসদের মত দলীয় মনোনয়ন এবং দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করায় গোটা দৃশ্যপট ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকলো। তৃণমূল পর্যায়ে দলের ভেতরে মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ ও দলাদলি, দলে দলে সংঘাত সন্ত্রাস প্রভৃতির শুরু হতে থাকে। প্রার্থী হিসেবে দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যক্তিটি ভাল কি মন্দ, সৎ কি অসৎ, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আছে কি নেই-সেই বিবেচনা প্রথা হিসেবেই উধাও ছিলো।

নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন নামক সোনার হরিণটি না পাওয়ায় মারামারি, ব্যক্তিগত অপপ্রচার, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে এক বা একাধিক “বিদ্রোহী” প্রার্থী দলীয় সহকর্মীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া, প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নেতৃত্বের সমর্থন আদায়ের প্রতিযোগিতার যে কোন মূল্যে-অর্থাৎ বিপুল পরিমাণে টাকার বিনিময়ে হোক বা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে হোক বা ভয় দেখিয়ে হোক বা পোলিং এজেন্ট হিসেবে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীর মনোনীত কাউকে ঢুকতে না দিয়ে বা কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দিয়ে সীল মেরে ভোট দিয়ে এ ধরণের নানা অবৈধ পদ্ধতি হিসেবে জিতে আসার প্রবণতা নির্বাচনগুলোতে ভয়াবহভাবে বাড়তে বাড়তে এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে নির্বাচন কমিশন বা রিটার্নিং অফিসারদেরকে প্রভাবিত করে সরকার দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত ছাড়া বাদ-বাকী কারও মনোনয়নপত্র গ্রহণ না করে মনোনয়নপত্র জমা দান, সেগুলি যাচাই-বাছাই, বৈধতা প্রাপ্ত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ, প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ এই সব প্রক্রিয়ার বুকে লাথি মেরে বিজয়ী বলে ঘোষণা প্রচার মিছিলের বদলে বিজয় মিছিল বের করাও কোথাও কোথাও শুরু হয়ে গেল।

একটি উদ্বেগজনক খবর বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ এর এক জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম ছিল “মনোনয়ন জমা হওয়ার আগেই ১১ ইউপি প্রার্থীর বিজয়”। এতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ষষ্ঠ ধাপে-মনোনয়ন পত্র জমার শেষ সময় আগামী ৩ জানুয়ারি কিন্তু কুমিল্লায় মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ১১ চেয়ারম্যান প্রার্থী ইতোমধ্যে কথিত বিজয় নিশ্চিত করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী ১৩ জানুয়ারি প্রার্থীতা প্রত্যাহারের পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কথা।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে ওই ১১জনকে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী বলেও স্থানীয়ভাবে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে এরই ১১ জনের বাইরে অন্য কারও কাছে মনোনয়ন পত্র বিক্রি করছেন না রিটার্নিং কর্মকর্তা।

অপরদিকে কেন্দ্রীয় নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভা ৩১ শে ডিসেম্বর বসতে যাচ্ছে। এর আগেই এই ১১ জন এক সঙ্গে এলাকায় ‘বিজয়ী প্রার্থী’ হিসেবে মোটর শোভাযাত্রা করে কবর জিয়ারত সহ নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ১১ জনকে নৌকার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে পোষ্টারও ছাড়া হয়েছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিনন্দনও জানান হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এর আগে ১১নভেম্বর ইউপি ভোটের দ্বিতীয় ধাপের মত এবারও সব ইউপিতে বিনাভোটে পছন্দের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে চাইছে প্রভাবশালী মহল। দ্বিতীয় ধাপে লাকসামের কান্দিরপাড়, গোবিন্দপুর, উত্তরদা, আজগরা ও লাকসাম পূর্ব ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসব স্থানে শুধু চেয়ারম্যান প্রার্থীই নয়। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ ওয়ার্ডের সদস্য মিলে ৬৫ জন মিলে বিনাভোটে নির্বাচিত হন। এবারও একই আয়োজন চলছে। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ মিলে কুমিল্লায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম।

ঐ উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান আফরুল ইসলামের ঘোষিত কথিত ওই ১১জন চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন ১নং বাইশ গাঁওতে আলমগীর হোসেন, ২নং সরসপুরে আবদুল মান্নান, ৩নং হাসনাবাদে কামাল রহমান, ৪নং ঝলম উত্তরে আবদুল মজিদ খান রাজু, ৫নং ঝলম দক্ষিণে আশিকুর রহমান হিরণ, ৬নং মৈশাতুয়ায় মফিজুর রহমান, ৭নং লক্ষণপুরে মহিন উদ্দিন চৌধুরী, ৮নং খিলায় আল আমিন ভূঁইয়া, ৯নং উত্তর হাওলায় আবদুল মান্নান হিরণ, ১০নং নাথের পেটুয়ায় আবদুল মান্নান চৌধুরী ও ১১নং বিপুলাসারে ইকবাল মাহমুদ। স্থানীয়দের অভিযোগ, মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পাহারা বসিয়েছেন। সেখানে কোন প্রার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

ধরণী দ্বিধা হও
আজ দু তিনটি মাস ধরে সারা দেশের শত শত ইউনিয়নের নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া, ভয়াবহ সহিংসতা, খুন-লুটপাট, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার উসকানী প্রদান, হুমকি ধামকি, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং আইন-বহির্ভূত এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র বিরোধী আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের যে অভিযাত্রা-তাতে এ কথা বলাই যায়, গণতন্ত্র নির্বাচনের নামে নির্বাসনে যেতে বসেছে। “জোর যার মুল্লুক তার” কথাটি নতুন করে প্রতিফলিত হতে চলেছে। এ ঘটনাগুলি সাবেক যুবরাজ রাজত্ব বাঞ্ছাদের রাজত্ব দখলের কাহিনী গুলোকেই ভিন্ন মোড়কে সত্য প্রমানিত করছে মাত্র।

বস্তুত: এসব নির্বাচনের সাথে জনগণের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। ফলে এগুলি কার্যত: নির্বাচনের নামে প্রহসন মাত্র। কিন্তু যেন তেন প্রকারে নির্বাচিত হওয়ার এই প্রবণতা কেন? অতীতে তো তেমনটা দেখি নি।

তবে কি ইউনিয়ন পরিষদ সমূহের চেয়ারম্যান মেম্বারদের পদ অত্যন্ত লোভনীয়? সেখানে মধুর সন্ধান মিলেছে ভাবছে দেখে তো তেমনটাই মনে হয়। বহু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, নানা অবৈধ ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছেন, কেউ কেউ চোখ ধাঁধানো বাড়ির মালিকও হয়েছেন। কিন্তু এই মধুর চাক কি চিরস্থায়ী। না-ইতিহাস তা বলে না। একদিন না একদিন জনগণ যখন ঐক্যবদ্ধ ঐ চাকগুলোতে ঠিল ছুঁড়তে যাবে-মৌমাছিদের তখন হয় মৃত্যু-নাহয় অজানা উদ্দেশ্যে অসহায়ভাবে পালিয়ে বাঁচতে হবে।

এর পরিণতিতে মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা নির্বাচন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা নিরর্থক ভেবে চুপ থাকাকে শ্রেয় মনে করছেন। অঘোষিতভাবে ভালো মানুষেরা, গণতন্ত্র প্রেমীরা, সৎলোকের নির্বাচনী রাস্তায় হাঁটাই বন্ধ করে দিয়েছেন।

আরও একটি বিজয় লক্ষ্যনীয়। যেসব ইউনিয়ন পরিষদে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারছে, মানুষ ইচ্ছামত ভোট দিতে পারছে-সরকারি দল এমন বহু এলাকায় নির্মমভাবে পরাজিত হচ্ছে। তাদের দলীয় জনপ্রিয়তাও নিম্নতর পর্যায়ে নেমে আসছে।

এগুলি শুধু মাত্র ইউ.পি নির্বাচনগুলির মধ্যেই সীমিত রয়েছে-তা নয়। বহু পৌরসভাতেও তেমনই পরিস্থিতি।

আর সংসদীয় নির্বাচন? তা নিয়ে যত মতানৈক্য তার কি সবই ভিত্তিহীন। যথার্থভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয় এমন ঘটনায় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দিনে দিনে সব কিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

তাই বেদনাদায়ক সত্যটি হলো, কথিত নির্বাচনগুলি প্রকৃত নির্বাচন নয়, এগুলিতে মানুষ সংশ্লিষ্ট নয়। তাই গণতন্ত্র এগুলির মাধ্যমে নির্বাসনে যেতে বসেছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

Labaid
BSH
Bellow Post-Green View