করোনার ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেই দায়-দায়িত্ব শেষ করার পরিণতি আমরা ভোগ করছি এবং আরও দীর্ঘদিন বিরতিহীনভাবে করোনার প্রকোপকে সঙ্গে নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে আমাদের। যুদ্ধ একটি সার্বজনীন বিষয় এবং যে কোন যুদ্ধের পটভূমিতে যুদ্ধের স্বপক্ষে মতামত দিয়ে নিজ গোষ্ঠীর বিরোধিতাকারীদের কূটকৌশলে পরাজিত হয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা জাতিটি। ঠিক তেমনিভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালি জাতি সফলতার চিহ্ন আঁকতে সক্ষম হবে না যতদিন পর্যন্ত প্রতিটি বাঙালি করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঐক্যে শামিল না হবে।
কাজেই, বাঙালি জাতি যতই লকডাউন, শাটডাউন পালন করুক না কেন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ ব্যতীত করোনার বিরুদ্ধে জয়লাভ অসম্ভব। কিছুদিন পর পর আমরা লকডাউনে যাচ্ছি, লকডাউনের সফলতা কতটুকু, কেনই বা করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না সে বিষয়ে যথার্থ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে প্রত্যেকটি বিষয়ের সঠিক কার্যকারণের নিশ্চয়তাই পারে করোনার বিরুদ্ধে শক্ত হস্তে দাঁড়াতে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে সফলতার হেতু প্রত্যেকেরেই জানা কিন্তু না মানার কারণে করোনাভাইরাস বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে অচল করে দিয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে, এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা প্রায় অসম্ভব। অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, দুশ্চিন্তায় অনেক শিক্ষার্থী আত্নহত্যা করছে, নানা ধরনের গ্যাং কালচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে কিশোররা। আবার এটাও হলফ করে বলা মুশকিল, আগামী অত দিনের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সশরীরে ক্লাস পরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাবে।
না মানার সংস্কৃতিতে প্রতিনিয়ত অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা, নিয়ম মানার চেয়ে নিয়ম ভাঙ্গতে পারদর্শী আমরা। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায় বিশ্বব্যাপী। ঠিক সে সময় যদি কড়া নিয়মে কড়া শাসনে ৭ দিন কিংবা ১৪ দিন যথার্থ লকডাউন পালন করা সম্ভব হতো তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এতদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতো না। কী আজিব বিষয়, সরকার লকডাউন ঘোষণা করলো এবং লকডাউনের ছুটিতে অনেকেই স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। এদিকে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের বাধ্যতামূলক লকডাউনের বিধি কার্যকর করতে ব্যর্থ হলো সরকার। সেই থেকে শুরু এবং শুরুর ভুলের খেসারত এখনো দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ এবং এ খেসারত আর কতদিন দিতে হবে সে বিষয়ে কেউই সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলছে না, তাছাড়াও বলাও সম্ভব হবে না। কেননা, কিছুদিন ধরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, মৃত্যুর হারও বেশ আশঙ্কায় ফেলে দিয়েছে সবাইকে।বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সরকার করোনার প্রকোপ মোকাবেলায় কিছুদিন পর পর সীমিত ও কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। এখানে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, লকডাউন তো লকডাউনই সেখানে সীমিত ও কঠোর ঘোষণা দিয়ে জনগণকে এক ধরনের দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
লকডাউন কিভাবে সর্বতভাবে কার্যকর করা যায় সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিতে পারেন, কোন পেশা-শ্রেণির মানুষের ভূমিকার অবহেলার কারণে লকডাউন কার্যকর করা যাচ্ছে না। সে শ্রেণির মানুষকে চিহ্নিত করে আলাদাভাবে হলেও সাহায্যের হাত প্রসারিত করে তাদেরকে নিয়ম মানার সুযোগ করে দিতে হবে। এক শ্রেণির কর্মজীবী রয়েছে যারা নিতান্তই পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে বের হয়ে স্বাস্থ্য বিধির ব্যত্যয় নিজেরা ঘটায় এবং অন্যদের দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে ও সংক্রমিত করছে অন্যদের। এক্ষেত্রে উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে, করোনার প্রকোপ মোকাবেলায় সরকার বড় অংকের সরকারি সাহায্য বরাদ্দ করেছে। বিষয়টা খুবই ইতিবাচক, কিন্তু নেতিবাচক তখনি হয়ে যায় যখন দেখা যায় যিনি ভুক্তভোগী তিনি সাহায্য না পেয়ে আর্থিকভাবে সামর্থবানরা সরকারি বরাদ্দ পাচ্ছে। এহেন কাজে সরকারি যারা অফিসার রয়েছেন যাদের দায়িত্ব থাকে তদারকির, মূলত তাদের যোগসাজশেই সামর্থবানরা সরকারি সাহায্য পেয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে সরকারি সাহায্য সেবা সম্বন্ধে ভুক্তভোগীরা তেমন অবগত নয়, আবার স্থানীয় সরকার বিভাগের অনেক অফিসেই কর্মরতরা সঠিক তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তথ্য অধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দেখার যেন কেউ নেই; অবশ্য যাদের দেখার দায়িত্ব তারাই হয়তো লিঁয়াজো করে অফিস পরিচালনা করে থাকে। তবে এও সত্য করোনাকালিন সময়ে অনিয়ম, অন্যায়ের বিচারও হয়েছে প্রকাশ্যে এবং সরকারি সেবা খাতের দূরবস্থার চিত্রও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, সরকারি ঘোষণা মানার ক্ষেত্রে ভীষণ দৈন্যতা পরিলক্ষিত হয় আমাদের মধ্যে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট দেখা যাবার পর সরকার ঘোষণা দিলো; সীমান্ত দিয়ে চলাচল বন্ধ কিন্তু সাধারণ জনগণ সেটা মানলো না।তারা যে কোন উপায় অবলম্বন করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গেল এবং ফেরার পথে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসলো। অবাক করার মতো বিষয় হলো ভাইরাসের নমুনা শনাক্ত হওয়ার পরে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো এবং তারা সেখান থেকে পালিয়ে অন্যত্র গমন করলো। কেমন নির্বোধ হলে আক্রান্তরা এহেন জঘন্য কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।কাজেই বলা যায়, না মানার সংস্কৃতিতে আমাদের আচ্ছন্নতা সর্বত্র। অধিকাংশ মানুষই নিয়ম কানুন ভঙ্গের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে থাকে। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না, এহেন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। উত্তরণের জন্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে এবং সেখানে সকলের জন্য আইন সমান এ নীতির বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, করোনাভাইরাসকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই, ভাইরাসটি তার শক্তিমত্তা ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী দেখিয়েছে এবং এখনো দেখাচ্ছে।কাজেই এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতকর্তাসহ সঠিক ব্যবস্থাগ্রহণই পারে করোনা ভাইরাসকে হটাতে। বিধি-বিধান, আইন মানতে হবে; সরকারি নির্দেশনা মানার যোগ্যতা তৈরি করতে হবে, নিজেদের দায়িত্ব-জ্ঞান সম্বন্ধে সজাগ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্যথায়, না মানার যে সংস্কৃতি আমাদের দেশে বিদ্যমান সেটির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের পথচলা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে যাবে। দেশের প্রত্যেকটি মানুষ যদি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ না করে তাহলে কখনোই করোনা মহামারীর ভয়াবহতা থেকে বাংলাদেশকে দূরে রাখা সম্ভব হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)