সেদিনের মিছিলে স্লোগান ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে নিরবে এগিয়ে চলছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনের দিকে। কিন্তু এই নির্বাক মিছিলের শত শত মুখ জানিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ ভুলে যায়নি।
তাঁর আলো ছড়ানো পথ থেকে সরে দাঁড়ায়নি। সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ সদস্যরা রোধ করতে চেয়েছে মিছিলের গতিপথ। কিন্তু সব বাধা দূর করে নির্ধারিত পথে ঠিক পৌঁছে যায় ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-পেশাজীবী-শ্রমজীবী মানুষের মিছিল।
তারিখটি ছিল ৪ নভেম্বর, ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানী ঢাকার রাজপথে প্রথম প্রতিবাদী মিছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু, দুর্ভাগ্য সে দিন প্রত্যুষে তাকে ধানমন্ডির বাসভবনে হত্যা করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রবল প্রতিবাদ কেন গড়ে তোলা যায়নি, সেই প্রশ্ন প্রায় সাড়ে চার দশক পরেও উঠছে। কিন্তু চরম বৈরি পরিবেশে ছাত্রসমাজ যে দুঃসাহসী প্রতিবাদে সামিল হতে পেরেছিল, তাকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই।

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে নামলে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হবে, এমন হুমকি ছিল। বাংলাদেশ এবং বাইরের কিছু সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কুৎসা রটনা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতৃত্ব দেন খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ। তিনি আওয়ামী লীগ ও বাকশালের শীর্ষ নেতা ছিলেন। তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সকলেই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা।
তিনি বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের সভা ডাকেন। জাতীয় ছাত্রলীগ নেতারা এ বৈঠক বর্জনের জন্য সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করেন। কিন্তু সেই অনুরোধ কাজে দেয়নি। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী শক্তি জামায়াত ইসলামী-মুসলিম লীগ এবং জাসদসহ কয়েকটি দল তখন বঙ্গবন্ধুর সমর্থকদের নির্মূল করার জন্য উন্মত্ত।
তাদের শক্তি ও সাহস জোগান ২৪ আগস্ট থেকে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন।
এমন প্রেক্ষাপটেই আসে ৪ নভেম্বর, ১৯৭৫- যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলা থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর মিছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয় শোক প্রস্তাব।
১৯৭৫ সালের ১০ জুন জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ২১ জন সদস্য গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও একই আমন্ত্রণ জানালে পরিদর্শনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৫ আগস্ট। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখান করে বলেছিলেন- আমি যে প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর, সেখান থেকে এ ধরনের সম্মান গ্রহণ করা অনুচিত ও অনৈতিক।
নীতি-আদর্শের প্রতি কী আনুগত্য! আমাদের মনে আছে, স্বাধীনতার পরপর একদল ছাত্রছাত্রী অটোপ্রমোশন দাবি করে উপাচার্য ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর অফিস ঘেরাও করে রাখলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ না পাঠিয়ে নিজে সেখানে হাজির হন।
নেতিবাচক আন্দোলনে যুক্তদের ভৎর্সনা করে তিনি বলেছিলেন- এমন গর্হিত দাবি ছাত্রদের দিক থেকে আসা অনুচিত। অটোপ্রমোশনের দাবি করা শিক্ষার্থীদের যুক্তি ছিল- মুক্তিযুদ্ধের কারণে শিক্ষা জীবনে থেকে প্রায় একটি বছর ঝরে গেছে। এ কারণে পরীক্ষা ছাড়াই ওপরের শ্রেণিতে তুলে দিতে হবে। অন্যদিকে, শিক্ষাবিদরা মত দেন- স্বাধীনতার জন্য এ বছরটিকে সকল শিক্ষার্থীর সম্মিলিত আত্মত্যাগ হিসেবে ধরে নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু এ মত মেনে নেন। ছাত্রনেতারাও এ মত সমর্থন করেন। এ অবস্থান নিতে গিয়ে মাহবুবজামান, কাজী আকরাম হোসেন ও আমি বটতলায় কিছু শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলাম। বিষয়টি আমরা গ্রহণ করি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের পুরস্কার হিসেবে।
১৯৭৫ সালের ৭ জুন বাকশালের একক ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ গঠনের পর শেখ শহীদুল ইসলাম ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে আমরা ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডে প্রচলিত ধারায় কিছু পরিবর্তন আনার কাজে হাত দেই। ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস থেকে অছাত্রদের বের করে দেওয়া হয়। ডাইনিং হলে ফাও খাওয়া বন্ধ হয়। অবাক ঘটনা ছিল, এ ধরনের অপকর্ম যারা করছিল তারাই ১৫ আগস্টের পর খুনিচক্রের দোসরে পরিণত হয়।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে প্রতিটি বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা সকালে সমবেত হয়ে শিক্ষকদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। তারপর প্রতিটি বিভাগের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জগন্নাথ হলের গণকবর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের কবরে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে সকল বোর্ডের সেরা ছাত্রছাত্রীদের ডাকসুর পক্ষ থেকে টিএসসিতে সংবর্ধনা জানানো হয়।
এসব কাজের প্রতি বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ সমর্থন ছিল। তিনি এ ধারা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে যে ভাষণ দেবেন, তাতে নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।
১৯৭৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে প্রবল বন্যার সময় আমন ধানের চারার ব্যাপক ক্ষতি হলে ডাকসুর পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানকে বীজতলায় পরিণত করা হয়।
এ উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান এবং গভীর রাতে গোপনে বীজতলা পরিদর্শন শেষে সহকর্মীদের বলেছিলেন, ছাত্ররা পড়াশোনার পাশাপাশি দেশের কাজে যুক্ত হোক, কৃষক-শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াক- এটাই দেখতে চাই।
বন্যার পর দুর্ভিক্ষ নেমে এলে তিনি রাজধানীতে লঙ্গরখানা পরিচালনার জন্য ডাকসুর হাতে শত শত মন আটা তুলে দেন। বন্যার সময় আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে রুটি তৈরি করে প্রতিদিন তা তুলে দিয়েছি বিমান বাহিনীর হাতে, যা বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে পৌঁছে দেয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকার জেলা প্রশাসক রেজাউল হায়াত মাহবুবজামান ও আমাকে বলেছিলেন ‘বন্যাত্রাণে ও দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় আপনাদের যা কিছু প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু সেটা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলরকে আমরা ১৫ আগস্ট স্বাগত জানাতে পারিনি। এর পরিবর্তে ফুল ছড়ানো পথে নেমে আসে ঘাতকদের বহনকারী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ির বহর।
যারা জাতির পিতাকে হত্যা করতে পারে, নারী-শিশুর প্রাণ সংহারে যারা কুণ্ঠিত হয়নি তারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটা কতটা নৃশংস হতে পারে সে ধারণা আমাদের ছিল। সঙ্গত কারণেই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের ডাক দিতে গিয়ে আমাদের সংযত হতে হয়। তদুপরি, ১৫ আগস্টের পরপরই রমজান মাস ও শারদীয় দুর্গোৎসবের জন্য টানা দুই মাস পাঁচ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জাতীয় ছাত্রলীগ নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেয়- ১৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দুই দিন পর ২০ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিন থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল বের হবে। এ কর্মসূচি সফল করার জন্য চলে গোপন প্রস্তুতি। ১৭ অক্টোবর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে লেখা হয় তিনটি স্লোগান- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। প্রথম দুটি স্লোগান ১৫ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধ ছিল, অন্যটি সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি।
২০ অক্টোবরের মিছিল মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে কলাভবন ও বটতলা প্রদক্ষিণ করে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কেবল ডাকসু সাধারণ সম্পাদক মাহবুবজামান বক্তব্য রাখেন। খুনি চক্র এ কর্মসূচির বিষয়টি আগে জানতে পারেনি। আমরা পরদিন ২১অক্টোবর ফের সমাবেশ ও মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করি। বলা যায়, গোপনীয়তার ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে আমরা প্রকাশ্য প্রতিবাদ সূচনা করি। শত্রুরাও প্রস্তুতি নেয়। তারা ২১ অক্টোবরের জমায়েতে হামলা চালায়। আমরা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হই। ফলে উৎসাহ বেড়ে যায়। এ দিনের মিছিল শেষে নূহ-উল আলম লেনিন ঘোষণা করেন- বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ২৯ অক্টোবর বটতলা থেকে মিছিল যাবে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। আমরা রাজধানীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ কর্মসূচির সমর্থনে প্রচার অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিই। লিফলেট ছাপা হয় বিপুল সংখ্যায়। শিরোনাম দেওয়া হয়- কাঁদো বাঙালি কাঁদো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে গিয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের এ কর্মসূচিতে যোগদানের আহ্বান জানাই। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীদেরও জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাঁর হত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ২১ অক্টোবরের সংঘর্ষের রেশ চলে কয়েকদিন। এ কারণে শোক মিছিলের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৪ নভেম্বর। সে সময়ে খুনিচক্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে সংবাদপত্র কিংবা বেতার-টেলিভিশনে আমাদের কর্মকাণ্ডের কথা প্রচারিত হতে পারেনি। মুখে মুখে প্রচারের ওপরেই আমাদের নির্ভর করতে হয়। আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরি। যে ছাত্রসমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তারা স্বাধীন দেশের স্থপতির হত্যাকাণ্ডের মতো অন্যায় মেনে নিতে পারে না, এটাই ছিল মূল কথা। এ কর্মসূচির বার্তা পৌঁছাতে গিয়ে আমাদের কয়েকজন কর্মী লিফলেটসহ গ্রেপ্তার হন। শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা প্রদানকালে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
৪ নভেম্বর সকালে শত সংগ্রামের পীঠস্থান বটতলা ছাত্র-জনতায় পূর্ণ হয়ে যায়। জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল আলম লেনিন, ইসমত কাদির গামা, ওবায়দুল কাদের, মাহবুবজামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন, রবিউল আলম চৌধুরী, মমতাজ হোসেন, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রমুখ জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অভিমুখে যাওয়া মিছিলের সামনে থাকেন। স্লোগান ছিল না মিছিলে। বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল, ব্যানার ছিল। নীলক্ষেত এলাকায় মিছিল পৌঁছালে বাধা আসে সেনাবাহিনী ও পুলিশের তরফে। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ সময় বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে আগের দিন সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণকারী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের হস্তক্ষেপে মিছিল এগিয়ে চলে ধানমন্ডি নম্বর সড়কের দিকে, যেখান থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সকলেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত। ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই প্রথম আমরা ওই পবিত্র, কিন্তু রক্তভেজা অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারি।
ওই কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারার স্বস্তি কাটতে না কাটতেই আমরা নিশ্চিত হই- ২ নভেম্বর গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর খুনি খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত হয়েছেন জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান। আমরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে কলাবাগান মাঠে সভা করে সিদ্ধান্ত নিই- ৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হবে। হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররমের সামনে অনুষ্ঠিত হবে গায়েবানা জানাজা।
শোক মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্র নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয় হরতাল সফল করার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে।
৪ নভেম্বর বিকেলে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশন। এজেন্ডা ছিল উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মাহবুবজামান, ইসমত কাদির গামা ও অজয় দাশগুপ্ত অধিবেশনে যোগ দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার নিন্দা ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন হয়। যে প্রতিষ্ঠানে তিনি আসতে পারেননি, তার সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেটে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা প্রকাশ ও ঘাতকদের বিচারের দাবিও জানানো হয়। পরদিন হরতাল ও গায়েবানা জানাজা শেষে বায়তুল মোকাররমের সামনের সমাবেশ থেকেও এ দাবি ওঠে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে জাতীয় শোক দিবস পালন এবং বাংলাদেশ বেতারের নাম পুনর্বহালের দাবিও জানানো হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, ৬ নভেম্বর মধ্য রাতের পর জিয়াউর রহমান ফের সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। খালেদ মোশাররফসহ বিপুল সংখ্যক সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়। নিষ্ঠুর সামরিক শাসনের কবলে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশ বাংলাদেশ।
পরিহাসের বিষয়- এ অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তিনি সামনে শিখণ্ডি হিসেবে রাখেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে।
৪ নভেম্বরের শোক মিছিল এবং ৫ নভেম্বরের হরতাল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বৈরশাসকদের কব্জা দৃঢ় হয়। কিন্তু এ সব প্রতিবাদী কর্মসূচি তাৎক্ষণিক ফল না দিলেও বাংলাদেশের মানুষ বুঝে যায় এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে- এটা নিছক স্লোগান থাকবে না। বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। এজন্য অপেক্ষার কাল কেবল দীর্ঘ হয়েছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)