চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দিল্লির ভারত রঙ্গ মহোৎসবে বাংলাদেশের জয়জয়কার

দিল্লী থেকে-

দিল্লিতে ভারত রঙ্গ মহোৎসবে একই বছরে দেখানো হয়েচে তিনটি বাংলাদেশী নাটক। যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি…

দিল্লির বাতাসে বইছে দেশ-বিদেশের থিয়েটারের সুবাস। মান্ডি হাউস গোলচক্করকে ঘিরে শহরের যে থিয়েটার পাড়া, সেখানে মহাধূম ধামে চলছে বর্ণাঢ্য নাট্যোৎসব। আর তাতে বাংলাদেশী থিয়েটারের আমেজও রম রম করছে।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে এই মুহুর্তে সে দেশের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)-র উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় থিয়েটার ফেস্টিভাল– যার নাম ‘ভারত রঙ্গ মহোৎসব’। এই মহোৎসব এবার কুড়ি বছর পূর্ণ করল, আর সেই জমজমাট আসরে প্রতিবারের মতোই ভারতের বিভিন্ন ভাষার ৮৯টি নাটকের পাশাপাশি পরিবেশিত হচ্ছে নানান দেশ থেকে আগত বিদেশি ১৫টি নাটক।

ভারত রঙ্গ মহোৎসবে এবারের এই আসরে সেই পনেরো নাটকগুলোর মধ্যমণি হয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে শুরু হওয়া বর্ণিল এই উৎসবে ইতোমধ্যেই মঞ্চায়িত হয়েছে বাংলাদেশ থেকে আসা তিনটি নাটক। ভারত রঙ্গ মহোৎসবের সুদীর্ঘ ইতিহাসে এর আগে কখনও বাংলাদেশের এতগুলো নাটক একসঙ্গে পরিবেশিত হয়নি।

অয়দিপাউস নাটকের একটি দৃশ্য…

২০০৮ সালে এই উৎসবে মঞ্চায়িত হয়েছিল বাংলাদেশের ফেম থিয়েটারের প্রোডাকশন ‘কাঠগড়া’। যা ছিল ভারতে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার ৫০তম বর্ষপূর্তি এবং সে বছর ভারত রঙ্গ মহোৎসবের দশম আয়োজনে প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করেছিল বাংলাদেশ। তারপর থেকে দিল্লির এই প্রেস্টিজিয়াস নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের থিয়েটার অনেকবারই এসেছে, কিন্তু একই বছরে তিনটি বাংলাদেশী নাটকের সুযোগ পাওয়ার ঘটনা এই প্রথম।

এবারের ফেস্টিভালে অংশ নেওয়া প্রথম বাংলাদেশি নাটক ‘অয়দিপাউস’ মঞ্চায়িত হয়েছে গত ৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় দিল্লিতে মান্ডি হাউসের কাছে এলটিজি অডিটোরিয়ামে পরিবেশিত হয়েছে এই নাটকটি। গ্রীক ট্র্যাজিডিয়ান সফোক্লিসের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘কিং অয়দিপাউস’ অবলম্বনে নির্মিত এই দুর্দান্ত নাটকটির পরিচালক ছিলেন চট্টগ্রামের ‘ফেম স্কুল অব ডান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজিকে’র কর্ণধার অসীম দাশ।

শুধু পরিচালনা নয়, এই নাটকটির মিউজিক, কস্টিউম, লাইট ও সেট ডিজাইন করেছেন অসীম দাশ নিজেই। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের এই ফেম থিয়েটারই এগারো বছর আগে ভারত রঙ্গ মহোৎসবে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।

দ্য ওপেন কাপল’ এর একটি দৃশ্য

দিল্লিতে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেলে এই নাটকটি যখন মঞ্চায়িত হয়, তখন দর্শক আসনে অন্যান্য গুণীজনদের সাথে উপস্থিত ছিলেন দিল্লী-প্রবাসী নির্বাসিত বাংলাদেশী লেখিকা ও কথাসাহিত্যিক তসলিমা নাসরিন। পরদিন নিজের ফেসবুক পোস্টে এই নাটকটি দেখার স্মরণীয় অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন তিনি।

এবারের উৎসবে দ্বিতীয় যে বাংলাদেশি নাটকটি মঞ্চায়িত হয়েছে, সেটি ছিল ঢাকার নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনা ‘দ্য ওপেন কাপল’। ইটালিয়ান নাট্যকার দারিও ফো ও তার স্ত্রী ফ্রাঙ্কা রেমের-র মূল রচনা অবলম্বনে নির্মিত এই নাটকটি ছিল কমেডিতে ভরপুর। আর এর নির্দেশনায় ছিলেন বাংলাদেশের সেলিব্রিটি নাট্যশিল্পী সারা জাকের। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল চারটায় শ্রীরাম সেন্টার মিলনায়তনে মঞ্চায়িত হয় এই নাটকটি।

‘দ্য ওপেন কাপল’ নাটকে প্রধান চরিত্র মাত্র দুটি। আর তার একটিতে অভিনয় করেছেন সারা জাকের নিজেই। বাংলা ছাড়া অন্য ভাষাভাষীর দর্শকদের বোঝার সুবিধার্থে এই নাটকের সংলাপ ইংরেজি সাবটাইটেলে পড়ারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।

ভারত রঙ্গ মহোৎসবে এবছর বাংলাদেশের তৃতীয় তথা শেষ পরিবেশনা ‘ম্যাকবেথ’ মন্চস্হ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্মেন্স স্টাডিজের ছাত্রছাত্রীরা। শেক্সপিয়রের অমর সৃষ্টি ‘ম্যাকবেথে’র এই রূপান্তরের নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ইশরাফিল শাহীন। নাটকটিতে সাধু বাংলা ভাষার প্রয়োগ করা হয়েছে। এই নাটকের মূল আকর্ষণ অসাধারন প্রজ্জলন দর্শকদের দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে।

গত রবিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল চারটায় শ্রীরাম সেন্টারে পরিবেশিত ম্যাকবেথে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও তার স্ত্রী তূহফা জামান আলী। রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে সে দিনের বাংলাদেশী পরিবেশনা যেন আলাদা একটা মাত্রা পেয়েছিল।

ভারত রঙ্গ মহোৎসবে বাংলাদেশী নাটক এই প্রথম এসেছে তা নয়। কিন্তু এবারের বাংলাদেশের পরিবেশনাগুলো নিয়ে দিল্লী বাসীর মধ্যে যে আগ্রহ আর উদ্দীপনা দেখা গেছে তা সত্যিই নজিরবিহীন।

মহোৎসবে বিদেশি নাটকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, রোমানিয়া, ইটালিসহ অন্যান্য দেশের বিভিন্ন নাট্যদল এসেছে তাদের প্রযোজনা নিয়ে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রযোজনা এসেছে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা থেকেই। তিনটি করে।

‘ম্যাকবেথ’ নাটকের এর একটি দৃশ্য…

‘ভারত রঙ্গ মহোৎসব ২০১৯’ এবার দিল্লির পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশটির ডিব্রুগড়, বারাণসী, রাঁচি, মাইসোর ও রাজকোট শহরে। দিল্লীতে এই আয়োজন টানা তিন সপ্তাহব্যাপী হলেও অন্যান্য শহরে উৎসবের উদযাপন অবশ্য এক সপ্তাহেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। আর দিল্লীতে পরিবেশনা শেষ করে বাংলাদেশের নাট্যদলগুলো তাদের প্রযোজনা নিয়ে হাজির হয়েছে সেই সব শহরেও।

ফলে শুধু রাজধানী দিল্লিতেই নয়, ‘কিং অয়দিপাউস’, ‘দ্য ওপেন কাপল’ ও ম্যাকবেথের মতো তিনটি অসাধারণ ও দর্শক মন জয় করা বাংলাদেশি প্রযোজনা দর্শকদের মন জয় করেছে সারা ভারত জুড়েই!

শীতের রেশ হালকা হয়ে বসন্ত যখন দ্বারপ্রান্তে সেই ফাল্গুন মৌসুমে বাংলাদেশের শিল্পীরা তাদের অসাধারণ প্রতিভা আর সৃজনশীলতায় রাঙিয়ে দিয়ে গেলেন এবারের ভারত রঙ্গ মহোৎসবকে!