
উন্নত জীবনের লোভে নৌকায় ভূমধ্যসাগরে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভিকটিমদের ত্রিপোলিতে বাংলাদেশী ‘গুডলাক’ দালালরা গ্রহণ করে। ভিকটিমরা তাদের ‘গুডলাক’ বা ‘গুডলাক ভাই’ নামেই ডাকে।
মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত দেশজুড়ে অন্তত ১০-১৫ টি চক্রের তথ্য পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন। যার মধ্যে ৫-৬ টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশিরা ৯ মে নৌদুর্ঘটনায় পতিত হন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি পাচারকারী চক্রের ৩ সদস্যকে আটক করেছে র্যাব-১। আটকরা হলেন- আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও আব্দুর রাজ্জাক ভুঁইয়া (৩৪)।
শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

তিনি বলেন, গত ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবিতে প্রায় ৮৫-৯০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশী ছিলেন ৩৯ জন। এ ঘটনার ঘটনার প্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা শরিয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় ২টি মামলা দায়ের করেন।
ওই মামলার ছায়াতদন্তের প্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইটি চক্রের ৩ জনকে আটক করা হয়। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলো। তারা প্রথমে বিদেশে গমনেচ্ছুক নির্বাচন করে, এরপরের ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সর্বশেষ ধাপে লিবিয়া থেকে তাদেরকে নৌপথে ইউরোপে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা ৭-৮ লাখ টাকা অর্থ নির্ধারণ করে, যার মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এর মধ্যে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ হয়ে যায়, যার ফলে ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরত আসতে পারেননা ভুক্তভোগীরা।
বিজ্ঞাপন
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে পাচারে তিনটি রুট ব্যবহৃত হয় জানিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন: রুটগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ – ইস্তাম্বুল (তুরস্ক) – লিবিয়া, বাংলাদেশ – ভারত – শ্রীলংকা (৪-৫দিন অবস্থান)- ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)- লিবিয়া এবং বাংলাদেশ – দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান) -আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট) – বেনগাজী (লিবিয়া) – ত্রিপলি (লিবিয়া)। এ ক্ষেত্রে তারা সড়ক পথ ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছাতো। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনেশিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে।
ভিকটিমরা ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশী কথিত ‘‘গুডলাক ভাই”সহ আরও কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তাদেরকে ত্রিপলিতে বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। এ সময়ে তারা ভিকটিমদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে।
সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌ-যান চালনা এবং দিক নির্ণয় যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়ের উপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর রাতে এক সঙ্গে কয়েকটি নৌ-যান লিবিয়া হয়ে তিউনেশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
মুফতি মাহমুদ বলেন, গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশীরা সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তারা ৫-৬ টি চক্রের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: আটক তিন সদস্যের চক্রের মাধ্যমে কতজন সেখানে গিয়েছিলেন বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়া, দেশজুড়ে ১০-১৫ টি চক্রের খবর আমরা পেয়েছি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
বিজ্ঞাপন