নবী হোসেন। খুব সাধারণ একজন মানুষ। জীপন যাপনও ছিলো তার অত্যন্ত সাদামাটা। লোকে তাকে ‘পাগল’ বলতো। গফরগাঁও উপজেলার দেউলপাড়া গ্রামে একটি জীর্ণ মাটির ঘরে মাটি দিয়ে বানানো চৌকিতে থাকতেন। যখন থেকে নবী হোসেনকে দেখছি, তখন থেকেই দেখতাম একটি ব্যাগ হাতে ময়লা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে বড় বড় দাড়ি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এ পাড়া থেকে ওপাড়া! আর কখনো কাওরাইদ স্টেশনে দাঁড়িয়ে কখনো গয়েশপুর বাজারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দিচ্ছেন! অবিকল বঙ্গবন্ধুর গলা নকল করে। পুরো জীবন শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ বলে কাটিয়ে দেয়া এক পাগল ছিলেন নবী হোসেন।
মানুষটার চিন্তায়, চেতনায় এতোটাই বঙ্গবন্ধু জুড়ে ছিলেন যে স্বৈরাচার এরশাদ যখন ক্ষমতায় তখন গফরগাঁওয়ে তার একটা জনসভা চলছিলো। নবী হোসেন তখন পুলিশ, আর্মির ভয় তোয়াক্কা না করে এরশাদের কাছাকাছি গিয়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়ে বসেন ‘স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়’। সাথে সাথেই এরশাদের পুলিশ আর্মি তাকে ঘিরে ধরে। পরে স্থানীয় জনগণ তাকে ‘পাগল’ বললে ছাড়া পান নবী হোসেন। নব্বইয়ের সেই উত্তাল সময়ে সবাই যখন রাত ৮ টার বাংলা ও রাত ১০ টার ইংরেজি খবরসহ নানা রকম খবর রেডিও, টিভিতে শুনতো, দেখতো তখন নবী হোসেনও সেই জমায়েত এ থাকতো।এভাবে খবর শুনতে শুনতে সে নিজের পরিচয় দেয়ার সময় বলে উঠতো ‘দি নিউ রেড বাই নবী হোসেন’। পাইথল ইউনিয়নের মানুষজন এরপর থেকেই নবীকে চিনে ‘দি নিউ রেড বাই নবী হোসেন’ নামে।


বিজ্ঞাপন
ঠিক একইভাবে ২০০১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন এই বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ ‘পাগল’ মানুষটি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিতো। কতো লোকের কাছে যে তাকে মার খেতে দেখেছি, শুধু ‘জয়বাংলা’ বলার জন্য। নানা রকম অত্যাচার, নিপীড়ণ তাকে জয়বাংলা থেকে সরাতে পারেনি।
একটি বৈরাগী জীবন ছিলো তার। বয়েসকালে বিয়ে করলেও সে সংসার তার টিকেনি। এরপর আর বিয়ে করেননি। একার জীবন ছিলো তার। লোকের দেয়া খাবারই তিনি খেতেন, যদিও সবার কাছ থেকে খাবার নিতেন না। যাকে তার ভালো লাগেনি সে জোর করে খাবার বা অন্যকিছু দিলেও তিনি নেননি। আর যাদের তিনি ভালোবাসতেন তারা তাকে কিছু দিলে সেটা সে কুকুর, বিড়াল ও পাখিদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে খেয়ে নিতে দেখিছি।

সারাজীবন আওয়ামীলীগ, মুজিব, হাসিনা, নৌকা করে যাওয়া লোকটা এলাকায় আওয়ামীলীগ নেতাদের কাছ থেকে বা দলীয় কোন সুবিধা তেমনভাবে পাননি কখনো। নির্লোভ এক জীবন ছিল তার। তবে করোনার সময় তিনি সত্যি সত্যি ভীষণ দুর্দশায় পড়ে গিয়েছিলেন। একার জীবনে খাবার জোগাড় করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তার দুর্দশার কথা জানলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। দলীয়ভাবে কোন ত্রাণ না পেয়ে মনের কষ্টে নাকি তিনি বলেছিলেন, ‘এদের আওয়ামী লীগ আমি করি না’! অভিমান ছিলো স্থানীয় নেতাদের প্রতি।
তবে করোনাকালে তার জন্য সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে গয়েশপুর জন কল্যাণ সংঘ, জয়ধরখালী জনতা সংঘসহ তরুণদের কিছু সামাজিক সংগঠন। এগিয়ে আসে দেউলপাড়া গ্রামের প্রতিবেশীরা। কিন্তু এসব আর তার অভিমান ভাঙাতে পারেনি। আজীবন বৈরাগী, বিপ্লবী, বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রাণ মানুষটি সোমবার ২৯ জুন সকাল সাড়ে ৬ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে একটা মিথেরও মৃত্যু হলো যেন! আমাদের শৈশবে আনন্দ দেয়া, মুখে মুখে জয়বাংলা ছড়িয়ে দেয়া ‘দি নিউ রেড বাই নবী হোসেন’ এর আত্মার শান্তি কামনা করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)