‘মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল মরণোত্তর চোখ দান করে যাবেন। পারেননি। কারণ মৃত্যুর পর ১২ ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মায়ের ইচ্ছাটা আমি পূরণ করতে নিজের চোখ দান করেছি লায়ন্সে। আমার মৃত্যুর বার ঘন্টার মধ্যে যেন আমার কর্ণিয়া সংগ্রহ করা হয়। সে কর্ণিয়ায় কারো চোখের আলো ফিরলে তবেই তো মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ হবে। মা কবিতা লিখতেন। তার নীলচে ডায়েরিটায় কত যে কবিতা ছিল। আজ কাজী নজরুল ইসলাম, আোদের জাতীয় কবির জন্মদিন আর আমার মায়েরও জন্মদিন। কি যে ভালো লাগে। মা আমার কাছে থাকলে কি যে ভালো লাগত। মাও নেই তার নীলচে ডায়েরিটাও আর পাইনি। আকতারুজ্জামান মামার কাছে ছিল। হারিয়ে গেছে। আমি তো তখন ভারতেশ্বরী হোমসে। ফলে ডায়রিটা আর সঙ্গে ছিলোনা। ক্লাস এইটে উঠে মায়ের ডায়েরিটা হাতে পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। কত যে কবিতা লেখা ছিল। আমি গর্বিত আমি টিনা খানের মেয়ে।’
‘মায়ের সঙ্গে আমার একটা ছবিও নেই। হয়ত ছিল। তাও মনে হয় হারিয়ে গেছে। এতই ছোট ছিলাম মায়ের মৃত্যুর সময়। মাত্র সাড়ে চার বয়স। কিন্তু তারপরও মা আমার প্রতিটা মূহুর্তে উপস্থিত থাকেন।’
শুটিং স্পট থেকে ফোনে বলছিলেন পুরোদস্তুর অভিনেত্রী রিমু রোজা খন্দকার। টিনা খানের একমাত্র কন্যা।
অকাল প্রয়াত টিনা খানের আসল নাম ফিরোজা রহমান টিনা। ‘রজনীগন্ধা’, ‘মৌ চোর’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘ লাগাম’, ‘দুই জীবন’, ‘এরই নাম প্রেম’ ‘একাই একশো’র মত সিনেমা আছে তার অভিনয় জীবনে। কিন্তু এখনও সবাই তাকে মনে রাখে ‘প্রিন্সেস টিনা খান’ সিনেমার জন্য। ১৯৮৫ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল এই সিনেমা। ছবিসহ আরো বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন। নিজ প্রযোজনায় প্রয়াত সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার আক্তারুজ্জামানকে দিয়ে যাত্রাশিল্পীদের জীবনী নিয়ে ‘প্রিন্সেস টিনা খান’ নামে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। সিনেমার প্রয়োজনে তাঁর নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল ‘খান’। সেটাই চিরস্থায়ী হয়ে গেছে নগরবাড়ি ফেরীঘাটে ১৯৮৯ সালে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। সেই দুর্ঘটনায় জীবনের ‘সীমানা পেরিয়ে’ গিয়েছিলেন নির্মাতা আলমগীর কবীর। একই দুর্ঘটনায় পতিত হলেও বেঁচে যান নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম ও মনিরা মোরশেদ মুন্নী।
১৯৬৬ সালের ২৫ মে চুয়াডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন টিনা খান। ছোটবেলা থেকে নাচ আর অভিনয় ছিল তাঁর ভালোবাসা। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় খন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ঢাকাতে স্থায়ীভাবে চলে আসার পর তিনি আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের দলে যোগ দেন। প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশামের ‘বিমানবালা’ সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ হয় তার। প্রায় ২৫টি বাণিজ্যিক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। সব সময় চাইতেন শিল্পী হতে। ‘নায়িকা’ কথাটাতে তাঁর আপত্তি ছিল। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হলেও ভালো ছবি, ভালো চরিত্রের প্রতি গভীর ক্ষুধা ছিল তাঁর। যা কিনা তাঁর মৃত্যুর আগে বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভালো ছবি হলে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করবেন।
বই পড়া ও ছবি দেখার ভীষণ ক্ষুধা ছিল জেলা শহর থেকে উঠে আসা টিনার। জানার আগ্রহ ছিল অসীম। বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল তাঁর। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তাঁর হাতে ছিল দিবেন্দু পালিতের ‘ঢেউ’ বইটি। যে ঢেউ পড়তে পড়তে যমুনার পানিতে তলিয়ে গিয়েছেন গাড়িতে বসা অবস্থায় ঘাতক ট্রাকের ধাক্কায়। আবেগী রিমু বলেন, ভাবতে পারি না মৃণাল সেন, জ্যোতি বসুর মতো বড়মাপের মানুষদের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে কীভাবে সমন্বয় করতেন। বাংলাদেশের এমন একটি সৃজনশীল দলের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন তা বিস্ময় জাগায় মনে। দলটাতে ছিলেন আলমগীর কবির, মোরশেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ, তানভীর মোকাম্মেল, সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী, আক্তারুজ্জামান, আবু সাইয়ীদসহ অনেকেই।
পরিচালক আবু সাইয়ীদের ‘আবর্তন’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের উদ্বোধন করতেই আলমগীর কবিরের সঙ্গে তিনি বগুড়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে আরও ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম ও মুনিরা মোরশেদ মুন্নী। ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে ১৯৮৯ সালের ২০ এক ঘাতক ট্রাকের আঘাতে গাড়িটি যমুনা নদীর পানিতে পড়ে যায়। এতে মৃত্যু হয় তাঁর এবং আলমগীর কবিরের। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মোরশেদুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী। আলমগীর কবির তাঁকে নিয়ে মণিকাঞ্চন নামে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
নিরন্তর শিল্পক্ষুধার অভিনেত্রী টিনা খানের জন্মদিনে আনত স্মরণ ও শ্রদ্ধা।