বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর হার অন্য যে কোনো আক্রান্ত দেশের তুলনায় অনেক কম, তবে ধীরে ধীরে সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতিসহ সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কেবলমাত্র যদি কৃষি উৎপাদন কার্যক্রম বিবেচনা করি অন্যান্য অনেক খাতের তুলনায়, কৃষি খাত এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল। তবে এই উৎপাদন কার্যক্রমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কর্মসংস্থান কিংবা কৃষি নির্ভর শ্রমজীবীদের অবস্থান কিন্তু ততটা স্থিতিশীল নয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, কৃষিখাতের সরাসরি অবদান মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ। এই শ্রমশক্তি কৃষি শিল্পের অন্যতম প্রধান অংশীদার। চলমান এই করোনা মহামারির সময়ে কৃষিতে তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮৭ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের আয়ের অন্তত একটি অংশের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাদের শ্রম আয় করোনার মহামারির শুরু থেকেই প্রভাবিত হয়েছে।
আজমত আলী (ছদ্মনাম), প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত ধান কাটার মৌসুমে তার নিজ জেলা নেত্রকোনার বাইরে গিয়ে ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। বছরের এই সময়ে বোরো ধান কাটার মৌসুমে আজমত আলী কুমিল্লা, চাঁদপুর বা অন্য নিকটবর্তী জেলায় চলে যান তার শ্রম বিক্রয় করার জন্য। কিন্তু মহামারির এই বছর তিনি যখন কৃষি জমির মালিকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন তারা তাকে মহামারি চলাকালীন সময়ে আসতে নিষেধ করেন। কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে, একদিকে তাদের নিজ অঞ্চলেই ধান কাটার জন্য স্থানীয় শ্রমশক্তির প্রতুলতা আছে। অন্যদিকে করোনা মহামারি ফলে বোরো ধান কাটার পুরো মৌসুমটি আজমত আলীর বিনাশ্রমে আয় রোজগার ব্যতিতই অতিবাহিত হয়। যদিও সরকার এই ধরনের প্রান্তিক শ্রমজীবীদের করোনাকালীন দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, সরকার, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রকৃত শ্রমশক্তির চাহিদা জেনে নিয়ে শ্রমশক্তি সরবরাহকারী জেলাগুলিতে তা প্রেরণ করে। এর পরেও আজমত আলীর ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কম নয়। একইভাবে, শেরপুরের নিয়মিত ভ্যান চালক কামাল (ছদ্মনাম) এখন তার পেশাকে কৃষিকাজসহ অন্যান্য খণ্ডকালীন নিম্ন আয়ের কাজকর্মে পরিবর্তন করেন, যেহেতু তিনি আগের মতো ভ্যান চালানোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি মূলত নিম্ন আয়ের কৃষি এবং শ্রমজীবীদের করোনাকালীন সময়ে ক্রমাগতভাবে তাদের জীবিকার পরিবর্তনের বিষয়টি নির্দেশ করে। তারা এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা কোন না কোনভাবে কৃষি উৎপাদন, বিতরণ এবং বিপণনকে প্রভাবিত করছে ও করবে। যদিও এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অংশ হিসেবে দরিদ্র জনগণকে ত্রাণ সরবরাহ কিংবা দরিদ্র কৃষকদের ঋণ সুবিধা দেওয়ার মতো বিভিন্ন কর্মসূচী সরকার ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করছে, তার পরও প্রশ্ন হচ্ছে এইসব উদ্যোগের দ্বারা এই মানুষগুলো দীর্ঘমেয়াদে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তরটি হবে “অনিশ্চিত”। কারণ ত্রাণ কিংবা ঋণ সুবিধায় দেশের এই বিপুল শ্রমজীবী হতদরিদ্র জনসংখ্যাকে পুরোপুরি আওতাধীন করা কঠিন, তার পাশাপাশি এইসব সুবিধা পৌঁছাবার ক্ষেত্রে রয়েছে প্রশাসনিক ত্রুুটি বিচ্যুতি – রয়েছে ইনক্লুশান কিংবা এক্সক্লুশান ত্রুুটি।
তার উপর ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বন্যা এসে এইসব অসহায় মানুষদের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়েছে। কৃষি ও শ্রমজীবীদের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিবেচনা না করে কিংবা একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা না করে অর্থ প্রেরণ স্বল্পকালীন সময়ে কাজে আসলেও প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদে শ্রমজীবিদের সহায়তা যা তাদের বর্তমান অবস্থা থেকে বের করে এনে দিবে আর্থিক স্থিতিশীলতা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণ করোনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে মূল ভূমিকা পালন করবে। যেমন, প্রথমত দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা। সরকার এবং বেসরকারী সংস্থাগুলি এক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে দরিদ্র শ্রমজীবী তথা জনগণের জন্য খাদ্য সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। তারপর প্রতিটি অঞ্চলের অতি-দরিদ্র অংশকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা চিহ্নিত করে তাদের মাধ্যমে অনাবাদী জমিতে ফসল বা শাকসব্জির ফলনে এবং সর্বোপরি খাদ্য উৎপাদনে শ্রম সরবরাহ করতে উৎসাহিত প্রদান করা।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন: বাড়ির প্রতিটি কোনায় যেখানেই সুযোগ আছে সেখানেই শাকসব্জি ফলনসহ খাদ্য উৎপাদনের ব্যাপারটি গুরুত্ব সহকারে নিতে। এই উদ্যোগটি কেবল আমাদের নিজস্ব খাদ্য সুরক্ষাই নিশ্চিত করবে তা নয়, আয়ের একটি উৎস হিসেবেও মূখ্য ভূমিকা রাখবে। আমাদের লক্ষ্য হতে হবে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহকে স্থিতিশীল করা, যাতে করে উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি। সরকারের সাথে সাথে বেসরকারী সহযোগিতার বড় একটি উদ্যোগ হতে পারে গ্রামীণ ও কৃষিভিত্তিক জনগনকে ছোট ছোট কৃষিনির্ভর কর্মসূচি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। বাস্তবায়নের জন্য এনজিওগুলিকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে কারণ এনজিওগুলির গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষদের ক্ষুদ্রঋণ সুবিধা প্রদানসহ নানা রকম উন্নয়ন কর্মসূচী পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এগুলো ছাড়াও কৃষকরা যারা সরাসরি কৃষিকাজের সাথে তাদের মানসম্পন্ন বীজ, সার এবং কীটনাশক প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত, যা সামনের বছরগুলিতে কৃষি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে রাখবে অগ্রণী ভুমিকা। সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত ৪% সুদের হারে ঋণ বিতরণ কর্মসূচিও নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়াও প্রয়োজন প্রান্তিক কৃষি ও শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি কর্মসূচির আওতাধীন করতে নীতিমালা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রদান করা। করোনার শুরু থেকেই বিভিন্ন এনজিওসহ সরকার নানা রকম স্বাস্থ্য সচেতনতামুলক কর্মকাণ্ড দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সক্রিয় রয়েছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব সর্ম্পকে বোঝাতে সক্রিয় রয়েছে করোনার হেল্পলাইন, করোনা সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহের ওয়েবসাইট, রেডিও টেলিভিশনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পদক্ষেপ। তারপরও মূল বিষয় হল কৃষি খাতে নিয়োজিত কৃষি ও শ্রমজীবিরা স্বাস্থ্য
সচেতনতা সম্পর্কে অজ্ঞতা বা উদাসীনতা।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, করোনা পরিস্থিতিতে কৃষিখাতে জড়িত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর যদি করোনার প্রভাব পড়ে তা সামগ্রিকভাবে কৃষি অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী নতুন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নিয়মাবলী জানার এবং অনুসরণ করার এখনই প্রকৃত সময়। তাই এই স্বাস্থ্য সতর্কতাগুলো যত দ্রুত সম্ভব কৃষি ও শ্রমজীবীদের মাঝে রপ্ত করানো প্রয়োজন। এই নিয়মাবলী কেবল কৃষিনির্ভর শ্রমজীবীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়ানোকেই নিশ্চিত করবে না, কৃষি বাজারে পণ্যের নিয়মিত প্রবাহকেও নিশ্চিত করবে।
আমরা বর্তমানে করোনার এই প্রাদুর্ভাবে এক অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছি, যা পৃথিবীতে শত বছর পর এসেছে এবং এটি আমাদের স্পষ্টভাবেই জানান দিচ্ছে যে, মানবজাতি প্রকৃতির কাছে কতটা অসহায়। কৃষিকাজ মানবজাতির প্রাচীনতম পেশা। এই পেশা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, করোনার প্রভাব কৃষি খাতে পড়লে তার ব্যাপ্তি হবে অনেক বেশী। একটি দেশ যতই প্রগতিশীল হয়ে উঠুক না কেন তার প্রধান লক্ষ্য থাকে জনগণের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা। মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য সবার প্রথমে তাই খাদ্য প্রবাহকে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা এক অত্যাবশ্যকীয় চ্যালেঞ্জ। এই প্রবাহকে সচল রাখতে, কৃষিক্ষেত্রের পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অগ্রগতি নিশ্চিত করার প্রকৃত সময় এখনই।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই যথাযথ দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এই খাতকে ও এই খাতের সাথে জড়িত কৃষি শ্রমজীবীদের ঝুঁকিমুক্ত রাখার জন্য করণীয় সব কিছুই করা দরকার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)