গত ২৩ জুন থেকে এ পর্যন্ত থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই শহরের ন্যাশনাল পার্ক লাগোয়া জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকার থাম লুয়াং নাং নন গুহায় আটকা পড়ে আছে ১২ কিশোর ফুটবলার আর তাদের ২৫ বছর বয়সী কোচের দলটি।
টানা ৯ দিনের চেষ্টায় তাদের কাছে পৌঁছানোর পর আরও ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও দলটিকে বের করে আনার ব্যবস্থা করতে পারেনি উদ্ধার কর্তৃপক্ষ। তার মূল কারণ টানা অতিবৃষ্টিতে গুহার ভেতর সৃষ্ট তীব্র স্রোতের বন্যা আর গুহার গিরিপথের প্রতিকূল গঠন।
যেখানে খোঁজ মিলেছে ক্ষুদে ফুটবলারদের
‘মু পা’ বা ওয়াইল্ড বোরস ফুটবল অ্যাকাডেমির ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচ দই নাং নন মাউন্টেন রেঞ্জের ৬ মাইল, বা প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা থাম লুয়াং নাং নন গুহায় আটকা পড়ে আছে। এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দীর্ঘ গুহাগুলোর একটি।
গুহার কিছু কিছু জায়গায় ছাদ ১০ মিটারেরও বেশি উঁচু। কোথাও আবার এতটাই চাপা যে পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকাও মুশকিল।
গুহায় ঢোকার পথ বেশ চওড়া। সেখানেই ফুটবল দলটির সাইকেল আর ফুটবল কিট চেইন দিয়ে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ভেতরে ঢোকার কয়েকশ’ মিটার পরই গিরিপথ সংকীর্ণ হতে শুরু করেছে।
তাই প্রবেশপথ থেকে প্রায় ৭শ’ মিটার ভেতরে তুলনামূলক চওড়া একটি খাঁজে রেসকিউ বেস তৈরি করেছে থাই নেভি সিল নেতৃত্বাধীন উদ্ধারকারী দল।
ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ধারকাজের শুরুর দিকে পানির বাড়তে থাকা উচ্চতার কারণে ক্ষুদে ফুটবলাররা গুহার আরও ভেতরে সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কে ঢুকে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
ওই সময় পানির কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছিল বারবার। পানির স্রোত, অন্ধকার আর কাদামাটির কারণে পরের প্রায় ৮শ’ মিটার পথ পেরোতে ডুবুরিদের সময় লাগে সপ্তাহখানেকের মতো। এর মাঝে আবার কিছু এলাকায় ভূমি থেকে ছাদের উচ্চতা ছিল এক মিটারেরও কম।
প্রবেশপথ থেকে প্রায় ১৫শ’ মিটার ভেতরে কিছুটা ফাঁকা এলাকায় রোববার পৌঁছায় ডুবুরি দল। ‘মংক’স জাংকশন’ হিসেবে চিহ্নিত জায়গাটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমে আসে এবং সেচের ফলে পানির উচ্চতাও নেমে যায় খানিকটা। পথ দেখতে সুবিধা হওয়ায় সেখান থেকে প্রথম গাইড রোপ (পথনির্দেশক দড়ি) বাঁধতে শুরু করে দলটি।
আরও শ’পাঁচেক মিটার গভীরে গুহা ওপরের দিকে উঠে গেছে। জায়গাটি পাতায়া বিচ নামে পরিচিত। উদ্ধারকারীরা আশা করছিলেন এখানেই নিখোঁজ ফুটবল টিমের দেখা পাবেন তারা।
কিন্তু এখানে পৌঁছে তারা দেখতে পান পুরো এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে আছে। গিরিপথের সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ এটি। এখান দিয়ে স্কুবা ট্যাংক পরা অবস্থায় পার হওয়া যায় না। ডুবুরিরা ট্যাংক খুলে পার হয়েছেন এই এলাকা।
আরও প্রায় শ’খানেক মিটার এগোনোর পর রয়েছে বেশ প্রশস্ত একটি জায়গা। সেখানে গুহার ছাদ ১০ মিটারের বেশি উঁচু। পাতায়া বিচ এলাকা থেকে প্রায় ২শ’ মিটার ভেতরে ঢোকার পর দু’জন বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ ডুবুরি নিখোঁজ ফুটবলারদের আবিষ্কার করেন পানি দিয়ে ঘেরা একটি ছোট উঁচু জায়গায়। জায়গাটি মূল প্রবেশপথ থেকে মোটামুটি ২ কিলোমিটার ভেতরে এবং ভূমি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উঁচুতে অবস্থিত।
যে অবস্থায় ছিল ক্ষুদে ফুটবলার আর কোচ
সন্ধান পাওয়ার আগ পর্যন্ত ৯ দিনের মতো গুহায় কোনোরকম সহায়তা ছাড়া থাকতে হয়েছিল মাত্র ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১২ কিশোর ও তাদের তরুণ কোচকে। তাদের কাছে কোনো খাবার ছিল না।
উদ্ধারকারীদের মতে, সঙ্গে একাধিক টর্চলাইট এবং মোবাইল ফোনের টর্চ ছিল। কিন্তু ৯ দিন জ্বলার পর একটা সময় ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় বহু ঘণ্টা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাটাতে হয়েছে দলটিকে।
তবে সৌভাগ্যবশত গুহার ভেতর তাপমাত্রা ছিল ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। তাই তীব্র ঠাণ্ডা বা গরমের শিকার হতে হয়নি ছেলেদের। পান করার যোগ্য পানি ছিল বলে পানিশূন্যতায়ও পড়তে হয়নি।
এছাড়া গুহার চুনাপাথরের দেয়ালের ছোট ছোট ছিদ্র এবং ফাঁটল দিয়ে ভেতরে যথেষ্ট অক্সিজেন ঢুকতে পারে। তবে পানির স্তর বেড়ে গেলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গুহার গঠনে উদ্ধারকাজে বাধা
১২ ক্ষুদে ফুটবলার আর তাদের কোচ যে গুহায় আটকা পড়ে গেছেন সেটি অনেকটাই সাপের মতো আঁকাবাঁকা। এর গুহাটি ছোটবড় সুড়ঙ্গ আর ফাটলে ভরা। কোনো কোনো অংশে গিরিপথ এতটাই সংকীর্ণ যে একজন মানুষকে হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয়। স্কুবা গিয়ার পরে সেই জায়গাগুলো দিয়ে চলাচল অসম্ভব।
এ কারণেই বন্যার পানি ভরা ওই জায়গাগুলো দিয়ে ফুটবল দলটিকে ডুবসাঁতার দিয়ে বের করিয়ে আনাটা দুঃসাধ্য বলে বিকল্প পথ খুঁজছে উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ।
টানা বৃষ্টির কারণে সেচ চেষ্টার পরও লম্বা উঁচুনিচু গিরিপথের কিছু জায়গায় বর্তমানে ৩০ মিটারের বেশি পানি জমে আছে। তাই এর আগে ধারণা করা হচ্ছিল, আটকে থাকাদের বের করতে হলে তাদেরকে স্কুবা গিয়ারসহ ডুবসাঁতার শেখাতে হবে। নইলে বন্যার পানি নামা পর্যন্ত তাদের কয়েক মাসও অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সেচের মাধ্যমে খুব বেশি পানি কমানো যাচ্ছে না। তাছাড়া টানা বৃষ্টিপাত চলছেই। দু’দিন বন্ধ থাকার পর ৪ জুলাই থেকে আবার শুরু হয়েছে বৃষ্টি। আবহাওয়া আরও খারাপ হয়ে আগামী ৮ জুলাই ৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
তাই কয়েক মাস চুপচাপ অপেক্ষা করাটাও খুব ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে আপাতত ডুবসাঁতার, সেচ ও খনন প্রক্রিয়া একসঙ্গে চালানোর কথা ভাবা হচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন চিয়াং রাইয়ের গভর্নর নারংসাক ওসোতানাকর্ন।
গুহার ভেতর যে ছোট উঁচু শুকনো জায়গাটায় ১৩ জনের দলটিকে পাওয়া গেছে তার ঠিক ওপর থেকে ড্রিলিং করে তাদের বের করার কথা প্রথমে ভাবা হলেও সেই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। কারণ ওই জায়গা থেকে বাইরে পাহাড়ের পৃষ্ঠের উচ্চতা ৮শ’ মিটার, অর্থাৎ প্রায় এক কিলোমিটারের কাছাকাছি। এত লম্বা পথ খনন করে ঢোকা একই সঙ্গে খুবই দুঃসাধ্য এবং বিপজ্জনক।
ক্ষুদে ফুটবলার দলটিকে সঙ্গ আর সাহস দেয়ার জন্য বর্তমানে সেখানে রয়েছেন চিকিৎসকসহ থাই নৌবাহিনীর ৭ অভিজ্ঞ ডুবুরি।