বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত গ্রুপ পর্বের ম্যাচের সময় প্রেস বক্সে বাফুফে মিডিয়া ম্যানেজার বারকয়েক সাংবাদিকদের অনুরোধ করে গেলেন। ফাইনাল ম্যাচটা মাঠে বসে দেখতে দর্শকদের যেন আমন্ত্রণ জানানো হয়। টুর্নামেন্টের প্রচার করা সংবাদ মাধ্যমের কাজ নয়, ফেডারেশনের দায়িত্ব। কিন্তু মনিকা-মারিয়া-আঁখিরা কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে বল পায়ে সৌন্দর্যের ফুল ফুটিয়ে চলেছেন তা যেন দেখতে না আসাটাই অন্যায়।
সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরের ফাইনালে রোববার দুপুর ২টায় ভারতের মুখোমুখি হচ্ছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। এই ভারতকেই শেষ ম্যাচে ৩-০ গোলে দাঁড়াতে দেয়নি গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা। নেপাল ও ভুটান ম্যাচ মিলিয়ে তিন ম্যাচে মোট ১২ গোল লাল-সবুজ কিশোরীদের। নিজেদের জালে বল জড়াতে দেয়নি একবারও।
মাঠের খেলায় মারিয়া মান্ডার দল মুগ্ধ করেছে সাংবাদিক থেকে শুরু করে মাঠের খেলা দেখতে আসা শ’পাঁচেক দর্শকদেরও। প্রেস বক্সেই কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকদের হাহাকার করতে শোনা গেল, ‘এমন খেলা ছেলেদের লিগেও দেখা যায় না!’
হাহাকারটাই যেন স্বাভাবিক। বয়স ১৫ বা এর কাছাকাছি। কিন্তু গোলাম রব্বানী ছোটনের ছাত্রীদের দেখলে মনে হয় বল পায়ে রাখার জন্যই এদের জন্ম। মাঠে নিজেদের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়া, ড্রিবলিং, উইং পরিবর্তন করে ডিফেন্ডারদের বোকা বানানো; দর্শকরা যারা স্টেডিয়ামে বিনামূল্যে খেলা দেখতে এসেছেন, বাড়ি ফিরেছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে।
পুরো দলটা যেন একটা পরিবার। গতবছরের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ী দলটির ১১ জন খেলোয়াড় আছে এই দলটিতে। বাকি যারা নতুন তাদের খেলা দেখে উপায় নেই জাতীয় দলের হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছেন। ফরোয়ার্ড সাজেদা বদলি হয়েই গোল। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম খেলতে নাম দুই খেলোয়াড় ফরোয়ার্ড রিতু পর্না চাকমা ও মিডফিল্ডার শামসুন নাহার মাঠে ছিলেন পুরো ৯০ মিনিট।
যাকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয়নি, সেই গোলরক্ষক মাহমুদা আখতারকে ব্যস্ত থাকতে হল প্রায় মাঝ মাঠে উঠে আক্রমণের মালা গাঁথতে। খেলার ধরণ যেন মনে করিয়ে দেয় পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার কথা। টিকি-টাকা ফুটবলের আদর্শ মানা যে দলের খেলার ভিত্তি ছিলেন গোলরক্ষক ভিক্টর ভালদেজও।
বাংলাদেশ দলটিতে খেলার নিয়ন্ত্রণ হাতে থাকে মাঝ মাঠে। দুই মিডফিল্ডার মারিয়া মান্ডা ও মনিকা চাকমার পা থেকেই জন্ম বেশিরভাগ গোলের। যেন বাংলাদেশ দলের জাভি ও ইনিয়েস্তা। বিশেষ করে মনিকা। মেসি ভক্ত লাল-সবুজ মিডফিল্ডারের ডিফেন্স চেরা পাস নেপাল ও ভারত ম্যাচে জয় পাইয়ে দিয়েছে স্বাগতিকদের।
গোল নিয়ে নেই কোনও হাহাকার। গ্রুপ পর্বে দুই ডজনের বেশি গোলের সুযোগ হাতছাড়া না হলে তিন ম্যাচে ১২ গোলের জায়গায় সংখ্যাটা হতে পারতো ২১ কিংবা ২২। চোটের কারণে নিয়মিত ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুনের ভারতের বিপক্ষে খেলা হয়নি। সেই ম্যাচে চোট পেয়েছেন আরেক ফরোয়ার্ড সাজেদা। তারপরও ঘাবড়াচ্ছেন না কোচ ছোটন। হাতে আছে আনুচিং মগিনি ও মার্জিয়ার মত তুরুপের তাস। রক্ষণ সামলে ডিফেন্ডার আঁখি খাতুন উঠে আসছেন আক্রমণে। ভুটান ম্যাচে জোড়া গোলও আছে তার। আর রাইট-ব্যাক ও লেফট-ব্যাকে আনাই মগিনি, শামসুন নাহাররা যেন হয়ে উঠেছেন প্রতিপক্ষের ত্রাস।
কিশোরীদের খেলার কৌশল অসাধারণ। কিন্তু তাদেরও তো চাই সমর্থকদের সমর্থন! কিন্তু মাঠে দর্শক কই? বাফুফে তাদের প্রচারণার কাজ সেরেছে স্টেডিয়ামের আশে পাশে কয়েক দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের খেলা দেখানোর কথা থাকলেও গ্রুপ পর্বে দর্শকরা খেলা বঞ্চিত। নেপাল ম্যাচের পরপরই বিনামূল্যে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে সাড়া দেওয়া বেশির ভাগ দর্শকই স্টেডিয়ামের আশেপাশে বসতবাড়ির দুপুরের ভাতঘুম বিসর্জন দেওয়া গৃহবধূ নয়তো শিশুকিশোর। বেশির ভাগ গ্যালারি থাকে ফাঁকা।
ছেলেদের ফুটবল পথ হারিয়ে র্যাঙ্কিংয়ে দুইশো ছুঁইছুঁই। দেশীয় ভারসাম্য আনার দায়িত্ব কাঁধে চাপিয়ে নারীদের অবস্থান সেরা ১০০তে। কিশোরীরা টানা দুবার এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশীপ জয়ী। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশীপে কাঁপিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মত পরাশক্তিকে। সাফের রানার্সআপ হয়েছে। সবগুলো টুর্নামেন্টই দেশের বাইরে। তাই খেলা দেখার সুযোগ হয়নি দেশী সমর্থকদের। কিন্তু ঘরের মাঠে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তো কিশোরীদের সমর্থন দেয়া তো সম্ভব! শিরোপার জন্য কিশোরীরা প্রস্তুত, সমর্থনের জন্য আপনিও আমন্ত্রিত।