চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কাতালোনিয়া সংকট: স্পেনের ভবিষ্যৎ কী?

স্পেনের গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট এই কাতালোনিয়া-স্বাধীনতা ইস্যু। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের পর এখন পর্যন্ত এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি দেশটি।

গত ১ অক্টোবর কাতালোনিয়ার বিতর্কিত স্বাধীনতা গণভোট থেকে বিক্ষোভ-সংঘাত-সংকটের শুরু হলেও কাতালান-স্প্যানিশ দ্বন্দ্ব কিন্তু খুব একটা নতুন বিষয় না। বহু বছর ধরেই ভেতরে ভেতরে দানা বাঁধছে দু’পক্ষের মাঝে বৈরিতা।

সর্বশেষ যা হলো
শুক্রবার রাজধানী মাদ্রিদে স্প্যানিশ সিনেট বসেছিল কাতালোনিয়া ইস্যুতে আলোচনার জন্য। ঠিক সেই সময়েই বিচ্ছিন্নতাবাদী এমপিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গঠিত কাতালান পার্লামেন্ট ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা বিরোধী এমপিরা সে সময় ভোট বয়কট করেন।

ভোটের মধ্য দিয়ে অঞ্চলটির সব ধরণের আইনি ক্ষমতা গণতান্ত্রিক রাজতন্ত্র স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীন ‘কাতালোনিয়া প্রজাতন্ত্রের’ কাছে হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়। এর অর্থ হলো, কাতালোনিয়া এখন থেকে আর স্প্যানিশ সংবিধান অনুযায়ী চলবে না।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জবাব দিলো মাদ্রিদ। প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় সংবাদ সম্মেলন ডেকে কাতালোনিয়া কেন্দ্রীয় শাসন জারির ঘোষণা দেন। এরপরই তিনি কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুজদেমন ও তার ক্যাবিনেটকে বাতিল ঘোষণা করে ২১ ডিসেম্বর ওই অঞ্চলে আকস্মিক নির্বাচন ঘোষণা করেন।কাতালোনিয়া-স্পেন

ইতোমধ্যে স্পেনের সিনেট দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংবিধানের ১৫৫ অনুচ্ছেদ কার্যকরের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এর ফলে মাদ্রিদ কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন বাতিল করতে পারবে।

অন্যদিকে কাতালান পুলিশ প্রধান ইয়োসেপ লুই ত্রাপেরোকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। তাকেসহ আরও দুই স্বাধীনতাবাদী কাতালান নেতাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

স্প্যানিশ সাংবিধানিক আদালত আগেই ১ অক্টোবরের গণভোটকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। এবার অঞ্চলটির স্বাধীনতার ঘোষণাকেও শিগগিরই অবৈধ ঘোষণা করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্পেন কি পারবে নিয়ন্ত্রণ নিতে?
স্পেন সরকার কত দ্রুত বা কতটা কার্যকরভাবে কাতালোনিয়ার ওপর কেন্দ্রীয় শাসন জারি করতে পারবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ১৫৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পেন সরকার যে কোনো সময় শাসন জারির ক্ষমতা রাখে।

কাতালান জনগণের মাঝে স্বাধীনতা নিয়ে এখনো গভীর বিভক্তি রয়েছে। একে কাজে লাগিয়ে মাদ্রিদ সরকার ওই অঞ্চলে লক্ষ্যণীয় সমর্থন লাভ করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

১ অক্টোবরের গণভোটে ২৩ লাখ ভোটারের ৯০ শতাংশ ভোট দিয়েছিল কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে। ভোটগ্রহণের দিন পুলিশের আচরণ, ভোটারদের ওপর লাঠিচার্জ এবং টেনে হিঁচড়ে ব্যালট বাক্সের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর দেশজুড়েই বিতর্ক শুরু হয় এ নিয়ে। এর মাঝেই কেন্দ্রীয় শাসন জারির জন্য আবারও এমন কঠোর ব্যবস্থা নিলে বার্সেলোনায় চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

কাতালোনিয়া-নির্দেশ-স্পেনএমন প্রতিক্রিয়া এড়াতে সরকার ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন ঠেকাতে পারে। সুযোগটি নেয়া সম্ভব, কেননা এই ‘সাময়িক’ কেন্দ্রীয় শাসনের মেয়াদ সংবিধানে বেঁধে দেয়া নেই। পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল না করে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়তো এভাবেই সম্ভব। কেননা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মাদ্রিদের ওপর চাপ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিতে হরতাল, বিক্ষোভ, বয়কট, মিছিলসহ অন্যান্য আরও পদক্ষেপ নিতে পারে।

এখনো সুযোগ আছে সমঝোতার?
দু’পক্ষ থেকে কিছু কিছু ছাড় দিয়ে এখনও সমঝোতার সুযোগ রয়েছে কাতালান-স্প্যানিশ সংকটে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোনো পক্ষই এতে আগ্রহী নয়।

কাতালান নেতা পুজদেমন স্পেন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহ না দেখিয়ে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কিন্তু স্পেন সেটা না চাওয়ায় আপাতত সেই সুযোগ থাকছে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণত স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ক সমস্যাগুলোতে বেশি আগ্রহ দেখালেও কাতালান সংকটকে স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অনেকটা এড়ানোরই চেষ্টা করছে। অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে সোজা মনে হলেও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে এ স্বাধীনতা অর্জন খুবই কঠিন এবং জটিলতাপূর্ণ। তাই কাতালোনিয়া ইইউ’র কাছে কতটা সহযোগিতা পাবে এটাও একটা প্রশ্ন।

অর্থনৈতিক চাপ কি হারিয়ে দেবে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের?

কাতালোনিয়া-স্পেন
বামে: মারিয়ানো রাহয়, ডানে: কার্লেস পুজদেমন

অর্থনীতি বর্তমানে কাতালোনিয়া এবং স্পেনের জন্য অনেক বড় একটি বিষয়। কাতালোনিয়া স্পেনের সবচেয়ে সম্পদশালী অঞ্চলগুলোর একটি হলেও মাদ্রিদের অর্থনীতি একে ছাড়াও খুব শক্তিশালী। গত ৫ অক্টোবর থেকে কাতালোনিয়া থেকে বড় কিছু ব্যাংকসহ বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সদরদপ্তর সরিয়ে নিচ্ছে। স্পেন সরকারও ব্যবসা সরিয়ে নেয়ার এই পদ্ধতিটি আরও সহজ করে দিয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত ১৬শ’রও বেশি প্রতিষ্ঠান কাতালোনিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে সরে এসেছে।

কাতালোনিয়া স্পেনের মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটির সরকারের কাছে কাতালোনিয়া প্রায় ৫২ বিলিয়ন ইউরো পরিমাণ অর্থের দেনায় ডুবে আছে। তাই এই ঋণের বোঝা আর আশপাশের অর্থনৈতিক চাপ সয়ে বিচ্ছিন্নতাপন্থিরা কতদিন টিকে থাকতে পারবেন সেটাও দেখার বিষয়।