চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

এই শহরে একটা স্বপ্ন ছিল

গভীর কালো রাতের আঁধারের পরেই দেখা দেয় সোনালি প্রভাত। শীতের আড়ষ্টতার যবনিকা হলেই প্রকৃতি রঙিন হয় শিমুলের বসন্তে। জরাজীর্ণ ধ্বংসস্তূপের বুক চিরেই জন্ম নেয় নতুন অট্টালিকা।

এগুলো চিরায়ত সত্য। কিন্তু আমাদের যে ঢাকা, ঢাকা নামের এই যে শহর, সেখানে নিয়মের কোনো ব্যাকরণই প্রযোজ্য নয়। এখানে শুধু আঁধার আর আঁধার। সোনালি প্রভাতের স্বপ্ন এই শহর নিয়ে দেখা যায় না। এখানে কোনো বসন্ত আসে না। এই শহর নিয়ে তাই কোনো স্বপ্নও দেখে না কেউ।

কোলকাতা শহর নিয়ে ১৯৯৯ সালে লেখা ‘The City of Joy’ বইয়ে লেখক ডমিনিক ল্যাপিয়ার কোলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন, “Here there is no more hope …… all that is left is anger.” আমাদের ঢাকাও তাই। এখানে আর কোনো আশা নেই। আছে দুঃখ, হতাশা, ক্ষোভ। সবচেয়ে বড় হয়ে আছে আমাদের অসহায়ত্ব। এই শহর বর্ষায় আমাদেরকে ডুবায়, শীতে উপহার দেয় ধুলোয় আচ্ছন্ন এক ‘অন্ধকার’ নগর, গরমে নগরবাসী হয়ে যায় দিশেহারা। দূষণ, যানজট, উপচে পড়া মানুষের দিগ্বিদিক ছুটে চলা, ফুটপাথ দখল, যেকোনো জায়গাকে গাড়ি পার্কিং এর জন্য ব্যক্তিগত ‘গ্যারেজ’ বানিয়ে ফেলা, ভিআইপি’দের অবাধ চলাচলের পথ করে দেওয়া, রাস্তা দখল করে মিটিং মিছিল করে ভয়ানক অবস্থা সৃষ্টিসহ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত এই নগরের প্রায় দুই কোটি মানুষ। প্রতিদিনের এই চিত্রের কাছে আমাদের অসহায়ত্বই শুধু প্রকাশ পায়; সমাধানের দেখা মেলে না। এই শহরটা সবার, কিন্তু এই শহরটাই আসলে কারো নয়। এই শহর দেখার মতো কেউ নেই। এই শহরে সবাই ‘রাজা’, তাই সত্যিকারের কোনো রাজা নেই। এই ঢাকায় এতো মানুষ, সত্যিকারের ‘মানুষের’ তবু কতো অভাব!

আনিসুল হক

এমনই এক প্রেক্ষাপটে এই ঢাকা কী এক আশ্চর্য প্রদীপের মতো আপানকে পেয়ে গেল! কোনো নিয়ম না-মানা ঢাকা আবার নিয়মের মধ্যে ফিরতে শুরু করল। এবং স্বপ্নরাও! ঢাকা শহর নিয়ে কোনো স্বপ্ন না-দেখা মানুষগুলো হতাশার কালো রাত্রির মধ্যেও স্বপ্নের নাগাল পেল, স্বপ্ন দেখার সাহস পেল।

প্রিয় আনিসুল হক, আপনি মেয়র হলেন, কিন্তু ঠিক মেয়রই হলেন না; আপনি হলেন কোটি নগরবাসীর স্বপ্নের কারিগর। জীবনে সম্ভাব্য সবকিছুই পেয়েছিলেন। অর্থবিত্ত, খ্যাতি, সম্মান, তারকাদ্যুতি- সব। তবু শেষ বয়সে পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী একটি শহরের দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন সত্যিকার অর্থেই এই শহরকে ভালোবেসেছিলেন বলে। সেই ভালোবাসার কী সার্থক অনুবাদই না করে চলেছিলেন আড়াই বছরের মেয়রজীবনে! একটি দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও কেমন নির্দলীয় মেয়র হতে পেরেছিলেন! বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। আপনিই প্রথম দেখালেন দলের হয়েও কীভাবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সবার’ হয়ে উঠতে হয়। আপনি দেখালেন কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন দেখাতে হয়। সে তো অনেকেই করে। আপনি আনিসুল হক; আপনি তো ‘অনেক’ নন। আপনি এক এবং অনন্য। তাই শুধু স্বপ্নই দেখালেন না; রাত দিন ছুটে চললেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাটা-বিছানো পথে।

জনাব মেয়র, আপনি যেদিন তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে গিয়ে শ্রমিকদের হাতে অবরুদ্ধ হয়েছিলেন, তবু পিছ পা হননি, নগরবাসী সেই দিনই জেনেছে- আপনি হেরে যেতে আসেননি। আপনি স্বপ্ন বেঁচে খাওয়ার মানুষ নন। আপনি স্বপ্নবাজ, আপনি স্বপ্নের অনুবাদক, আপনি কর্মী। তেমনি করে আপনি আরো কতো কি করলেন! গাবতলি বাস টার্মিনাল পার্কিংমুক্ত করলেন। বিলবোর্ড অপসারণ করলেন। আধুনিক গণশৌচাগার নির্মাণ করলেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আনলেন নতুন মাত্রা। ফুটপাত অবকাঠামো ও উন্নয়নেও দিয়েছিলেন বিশেষ গুরুত্ব। এবং আপনি মানবিকও প্রিয় মেয়র! যাদের শ্রমে ও ঘামে আপনার সুনিপুণ পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছিল, তাদেরকে আপনি ভুলে যাননি। আপনিই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দৈনিক মজুরি ১৭৫ টাকা থেকে ৪৭৫ টাকা করেছিলেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ মারা গেলে এক লাখ টাকা জীবনবীমা ও সাত লাখ টাকার অনুদান এবং গুরুতর আহত হয়ে কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেললে ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। বরাদ্দ করেছিলেন দুটি উৎসব ভাতারও।

 

ঢাকা শহর নিয়ে আপনার কর্মপরিকল্পনা ছিল বিশাল এবং অকৃত্রিম। প্রায় বিধ্বস্ত এক জনপদকে আপনি একটু একটু করে প্রাণময় করে তুলছিলেন। আধুনিক, পরিচ্ছন্ন, সবুজ এক নগরীর স্বপ্নে বিভোর করে তুলেছিলেন আমাদেরকে। সেই আমাদেরকেই স্বপ্নাবিষ্ট রেখে, আবারো অসহায় করে দিয়ে চলে গেলেন কোন সুদূরে! চলে গেলেন; কিন্তু সত্যিই চলে গেলেন কি? আড়াই বছরের কর্মযজ্ঞে আপনার হাতের কিংবা স্বপ্নের ছোঁয়া লেগে আছে নগরের পরতে পরতে। যে প্রাণময় জীবন্ত শহরের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই ঢাকা আমাদেরকে বার বার মনে করিয়ে দেয়- আপনি ছিলেন! এই শহরে একটা স্বপ্ন ছিল! আনিসুল হক নামের এক বিস্ময়কর মানুষ ছিলেন, যিনি আমাদের আশাবাদী হতে শিখিয়েছিলেন, প্রত্যাশার সৌন্দর্যে বিশ্বাসী করে তুলেছিলেন।

প্রিয় মেয়র, কোনো এক রহস্যময় অলৌকিক উপায়ে আপনার কাছে যদি এখন জানতে চাওয়া হতো, আপনি কী মিস করছেন? সম্ভবত আপনার উত্তর হতো- আমি ঢাকা শহরকে মিস করছি! আর এই আবার ‘আগের’ শহর হয়ে যাওয়া ঢাকাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়- ঢাকা শহর, তুমি কাকে মিস করছ। ঢাকা চিৎকার দিয়ে বলে উঠবে, আমি একজন মেয়রকে মিস করছি। আমি আনিসুল হককে মিস করছি!
কাজী নজরুল ইসলামের একটি অনুভূতির কথা এই মুহূর্তে বেশ মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, আমি ভোরের পাখি হয়ে তোমাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলাম, তোমরা গেয়ে ওঠো।

লোকান্তরের প্রিয় মেয়র, আপনিও এই ঢাকা শহরের মানুষদের ‘ঘুম’ ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা কি গেয়ে উঠবো? হে ঘুম ভাঙ্গানিয়া প্রিয় পিতা, আমরা কি পারব আপনার দেখানো পথে এই নগরকে একটি সত্যিকারের গানের, প্রাণের নগরে পরিণত করতে!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।