কান্নার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ভাবছি আমি নিজেও তো এই বুয়েটের ছাত্র ছিলাম আর বোবার মতো নির্বাক হয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। আমি তো এই বুয়েট রেখে আসিনি। বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের মিলন মেলার এই চেহারায় ভীষণ মর্মাহত, আমাদের সময়ও ছাত্র রাজনীতি ছিল সেই রাজনীতি তো এতটা দূষিত ছিল না।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র, মাত্র ২১ বছর বয়সী তরতাজা টগবগে তরুণ, আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্র নামধারী কিছু নরপিশাচ, যে ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। এই খুনিরাও কিন্তু মেধাবী ছাত্রদেরই একটি অংশ যারা বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। কারণ আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রদেরই একটি অংশ বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হয়।
এরাও তো কোনো নিরীহ বাবা-মা’র সন্তান…। সব বাবা-মা’ই সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায় মানুষের মতো মানুষ হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য। কিন্তু আবরারকে বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বিনা কারণে মৃত্যুবরণ করতে হলো!
আবরার হত্যাকাণ্ডের কারণ খুঁজতে খুঁজতে আমার কাছে প্রথমেই যে কারণটি চোখের সামনে ভাসছে তা হলো, সে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির নোংরা, অন্ধকার অংশের দ্বারা বিদ্ধ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের ফলাফল নিয়ে তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছিল। কী ছিল সেখানে? ভারত সফরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর কিছু জায়গায় সে দ্বিমত পোষণ করেছে। যেমন- ‘ফেনী নদীর পানির কিছু অংশ ত্রিপুরায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার জন্য ভারত টেনে নিয়ে যাবে এবং এলপিজি গ্যাস (আমদানিকৃত গ্যাসের একটি অংশ) ভারতে রপ্তানি’ প্রসঙ্গে এগুলো তার নিজস্ব মতামত। যে কোনো মতের বিরুদ্ধে কথা বলা কোনোভাবেই অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত মিডিয়া-নিউজপেপার, ইলেট্রনিক মিডিয়া, টক শো, সোশ্যাল মিডিয়াতে পক্ষে/বিপক্ষে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে, হতেই থাকবে এখানে সমস্যা কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।
আর এই ভিন্নমতের কারণে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী আবরারকে তার একতলার রুম থেকে ডেকে নিয়ে দোতালার একটি কক্ষে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। বুয়েটে এ জাতীয় নির্যাতন কক্ষ কখনও ছিল বলেও আমি শুনি নাই। ছাত্র রাজনীতির ভয়ংকর এই দিকটা কখনোই বুয়েটকে প্রভাবিত করতে পারেনি বলেই আমার বিশ্বাস ছিল। আর এই বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে প্রচণ্ড অস্থিরতায় আছি, ঘটনাটি কোনোভাবেই মানতে পারছি না। খুবই দুঃখজনক, বেদনাদায়ক!
আবরারের বাবা মামলা করেছে। পুলিশ এ পর্যন্ত বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ তেরো জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ তাদেরকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করেছে। বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা যে সাত দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে সেগুলোর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। দাবিগুলোর উল্লেখযোগ্য খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত, তাদের বুয়েটের ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে, হলগুলো থেকে ভিন্নমতালম্বীদের উপর নির্যাতনে জড়িত ছাত্রনেতা/কর্মীদের বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।
আমি বুয়েটের ছাত্র থাকাকালীন একই রুমে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের শান্তিপূর্ণ বসবাস দেখেছি, আবার মিছিল/মিটিং করে দল মত নির্বিশেষে সবাই আহসান উল্লাহ ক্যান্টিনে আড্ডা দেয়া, একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসা, দুঃখে কষ্ট গুলো শেয়ার করে একত্রিত থাকার দৃষ্টান্ত দেখেছি। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির গৌরব উজ্জ্বল অতীত আছে, তাদের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বুয়েটের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে এখনো বিশ্বাস করি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগ-যুবলীগের ভিতর যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন, তারই ধারাবাহিকতায় আবরার হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রভাব ছাড়া তদন্ত শেষে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে। খুব দ্রুত বুয়েটসহ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলমত নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নিশ্চিত হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)