ফ্লাস্কের চা-কফি এখন বেশ গরম থাকে। আগের মতো উৎকট গন্ধও থাকে না। যেখানে চা পাওয়া যায় না, সে জায়গাটিকে বন্ধ্যা মনে হয়। বাঙালি এক’শ বছরে জীবনকে গতিশীল রাখার জন্য যে মন্ত্রটি গভীরভাবে শিখেছে, তা হচ্ছে ‘চলুন চা খাই’। বইমেলায় মানুষের ভীড় হিসেবে চায়ের এন্তেজামটা কম। এতে অনেক চা পিয়াসী কিঞ্চিত দামী কফি খেয়ে ঘোলের স্বাদ দুধে মেটাতে বাধ্য হন।
সেদিন সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে এক সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণীকে দেখা গেল বইমেলায়। আর পাঁচজন পাঠক দর্শকের সঙ্গেই মিশে চলছিলেন। তার হাতে ভারী এক ফ্ল্যাস্ক হাতে। আমার পরিচিত কয়েকজন তার কাছ থেকে কফি খেয়েছেন। আমি কিছুক্ষণ মেয়েটিকে লক্ষ্য করলাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই স্টলে স্টলে যাচ্ছেন। কফি’র প্রস্তাব রাখছেন। বিমুখ করছেন কম মানুষ। খাচ্ছেনই বেশি। হিসেব করলাম, তার ফ্লাস্কটি শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এই সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বাণিজ্য শেষে মেয়েটি ঘরে ফিরতে পারবে। আমি মেয়েটির কোনো ছবি তুলিনি।
আশা কিংবা হতাশার কিছু নয়। এটি একটি দৃশ্যপট। এর মধ্যে শিক্ষা আছে। সৎভাবে উপার্জনের শিক্ষা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কাজকে ছোটো করে দেখা হয় না। আমাদের দেশে মুখে এই কথার ফুলঝুরি ছোটানো হয়, কিন্তু কাজকেই শুরু গৌণ করে দেখা হয় না, কাজের সঙ্গে মানুষটিকেও গৌণ করে দেখা হয়। যে কারণে, বেকারত্ব থাকলেই সহজে যেকোনো কাজে নেমে যেতে পারে না সবাই।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খাদ্যের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়াতে চাওয়া এক তরুণের আকুতি বেশ চাউর হয়। পরে ওই শিক্ষিত তরুণ কাজ পেয়েছেন, দারিদ্র ঘুঁচানোর মতো ব্যবস্থাও পেয়েছেন। কিন্তু ওই তরুণ যেকোনো কাজে নেমে পড়ার কথা ভাবতে পারেননি। রিক্সা চালাতে পারেননি। পথব্যবসায়ী বা হকার হতে পারেননি। তিনি নিজেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিজেকে ভেবে বসেছিলেন। ঠিক ওই উচ্চতার কিছু না পেলে কিছু করবেন না।

তাই খাদ্যের বিনিময়ে প্রাইভেট পড়ানোর একটি পোস্ট দিয়ে তিনি বেশ জমিয়ে নিতে পারলেন। যা হোক, এটি তার নিজস্ব বুদ্ধি বিবেচনা ও সৃজনশীলতার ব্যাপার। খাদ্য মানুষের জীবনধারণের পূর্বশর্ত সন্দেহ নেই, কিন্তু খাদ্যের প্রার্থনায় কাজকে সামনে আনার মতো মনোদারিদ্র নিয়ে আরো অনেক কথা বলার সুযোগ রয়েছে। আমি ফ্লাস্ক হাতে চা বিক্রি করা মেয়েটির কথা ভাবলাম।
আমাদের দেশে সচরাচর এমন দৃশ্য দেখা যায়না। অসংখ্য তরুণ দেখা যায়, স্বামী পরিত্যক্তা নারী দেখা যায়, কিন্তু পরিচ্ছন্ন সুন্দর পোশাকের শিক্ষিত তরুণী চা বিক্রি করছেন, এমন দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে তার এই সাহসটি অনেক দামী।
বইমেলায় গতবারও দেখেছি শিশুরা লাভক্যাণ্ডি নিয়ে ঘুরছে। মানুষের সামনে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ কিনছে, কেউ এমনিতেই কোমলমতি শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে দু’দশ টাকা দিচ্ছেন। এই ছদ্মবেশি ভিক্ষাবৃত্তি দেখে ওই শিশুদের জন্য মায়া হয়। কাল জানলাম, এক পরিবারের কয়েক শিশু বেরিয়েছে। মা তাদের পাঠিয়েছে। ওদের কথাবার্তা চালচলনে শিক্ষা আছে। সচেতনতা আছে। কিন্তু মানুষের সামনে হাত পাতার মধ্যে নিজের যে অক্ষমতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, সেই বোধটুকু ঘুমিয়ে আছে। আহা, বইমেলা! তোমাকেই বলি, এদের ভেতরটা জেগে উঠুক।
(চলবে)