চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

আসিফা ধর্ষণের তিন মাস পর কেন উত্তাল ভারত?

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জম্মু ও কাশ্মীরের শহর কাঠুয়ার রাসানা এলাকায় মুসলিম বাকারওয়াল সম্প্রদায়ের আসিফা বানুর ওপর চালানো নৃশংসতার তিন মাস পর উত্তাল ভারত।

মাত্র ৮ বছর বয়সেই যে ভীতিকর নির্যাতন তাকে সইতে হয়, তার কল্পনাও কষ্টসাধ্য। ধর্ষণ, হত্যার সেই অকল্পনীয় বর্বরতার বর্ণনাই এখন উত্তাল করে দিয়েছে ভারতকে। যদিও ধর্মীয় প্রলেপ দিয়ে ধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষে আন্দোলন হয়েছে।

অবশ্য ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই রাজ্য মন্ত্রী ধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষ নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আসিফা ধর্ষণের তিন মাস পর সম্প্রতি এর বিচার দাবি করে মন্তব্য করেছেন দেশটির দুই কেন্দ্রীয় নারী মন্ত্রী। শিশু ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আইন করার কথা বলা হয়েছে।

ন্যায় বিচার দাবি করে মিছিল করেছে বিরোধী দল কংগ্রেস। অভিযোগপত্র জমাদানে বাধা দেওয়ায় আইনজীবীদের সমালোচনা করেছেন দেশটির সুপ্রিমকোর্ট। অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে নৃশংসতার আদ্যোপান্ত।

আসিফা ধর্ষন ও হত্যার ঘটনা ঘটে জানুয়ারিতে। জানুয়ারির ১০ তারিখে আসিফাকে অপহরণ করা হয়। সে মাসেরই ১৮ তারিখে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা কাঠুয়ার কাছের একটি জঙ্গল থেকে।

জানা যায়, ঘোড়া চড়াতে নিয়ে গিয়েছিলো আসিফা। ১৯ বছর বয়সী একজন তখন তাকে ডেকে নিয়ে যায়। আসিফাকে জোর করে ঘুমের বড়ি খাওয়ানো হয়। একটি মন্দিরে আটকে রাখা হয়। এর পরের তিন দিন তিন জন মিলে তাকে ধর্ষণ করে বারবার।

‘‘তাকে না খাইয়ে রাখা হয়েছিলো পুরোটা সময়। এমনকি শ্বাসরোধে হত্যার আগে একজন পুলিশ অফিসার তাকে শেষ বারের মতো ধর্ষণের জন্য জোর করছিলো। তার মাথায় পাথর দিয়ে দুবার আঘাতও করা হয়। পরে জঙ্গলে তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায়।’’

কেন্দ্রীয় নেতারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বিষয়ে নীরব ছিলেন। তবে পুলিশের অভিযোগপত্রে বিস্তারিত প্রকাশিত হলে নির্মমতা ও ভয়াবহতার প্রচণ্ডতা সবাইকে হতভম্ব করে।

বৃহস্পতিবার ‘জুনিয়র মিনিস্টার অব স্টেট’ ভিকে সিং আসিফার জন্য ন্যায় বিচার চেয়ে কথা বলেন।  বিজেপির কোনো মন্ত্রী হিসেবে তিনি এই প্রথম এ বিষয়ে কথা বলেন। রাহুল গান্ধিও এ বিষয়ে ইতোমধ্যে টুইট এবং মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।

অভিযোগ উঠেছে, মুসলিম বাকারওয়াল সম্প্রদায়কে কাঠুয়ার রাসানা এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই ছিলো এই নৃশংস অপরাধের মূল উদ্দেশ্য। বাকারওয়ালরা জম্মুর জনসংখ্যার ৮ শতাংশেরও কম।

বিশ্লেষকদের মতে, এটা শুধুমাত্র ফৌজদারি অপরাধ নয়। জম্মুর অনেক রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি এবং আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবির সাথে এই অপরাধের মূল উদ্দেশ্যের মিল রয়েছে। মুসলিম যাযাবর এবং গুজ্জারদের উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছে তারা। জম্মু অঞ্চলে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন রুখতে এই দাবি তাদের।

অভিযোগপত্র
এই নৃশংস অপরাধের মূল হোতা সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা সাঞ্জি রাম। তার ছেলে ভিশাল, তার ভাতিজা (কিশোর) এবং স্পেশাল পুলিশ অফিসার দিপাক খাজুরিয়াও ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত। বাবার পরিকল্পনায় অপহরণ ও ধর্ষণে ছেলের সম্পৃক্ততা অনেককেই বিস্মিত করেছে। পুলিশের জমা দেওয়া ১৫ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে বিস্তারিত উঠে আসে। ৮ জনকে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

২০ মার্চ সাঞ্জি রাম আত্মসমর্পণ করে জম্মু কাশ্মীরের হাইকোর্ট ক্রাইম ব্র্যাঞ্চকে তাকে গ্রেপ্তার করতে বলে।

সাঞ্জি রাম
সাঞ্জি রাম

এই ঘটনার তদন্ত করার সময় পুলিশ ১৯ বছর বয়সী একজন স্কুল ড্রপআউটের সন্ধান পান। সে প্রায়ই মেয়েটিকে দেখতো ঘোড়া চড়াতে। এরপর পান কিশোরটির চাচা সাঞ্জি রামকে। তিনি একটি মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক। মন্দিরটি থেকে ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশ।

এই কিশোর প্রথমে নিজের বয়স ১৫ বছর দাবি করলেও মেডিকেল পরীক্ষা নিশ্চিত করে সে আন্ডার এজ নয়। তিনি ঘটনায় সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন এবং মেয়েটির শরীরে পাওয়া চুলের সাথে তার ডিএনএ মিল খুজে পায়।

অভিযুক্ত ২ সাঞ্জি রাম, সরকারের সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা এই জঘন্য অপরাধের মূল পরিকল্পনাকারী। ঘুষের জন্য বড় অঙ্কের টাকাও রেখেছিলো সে। কিশোরের স্বীকারোক্তির পর তাকে আটক করা হয়। ফরেনসিক পরীক্ষা এবং কয়েকজন সন্দেহকারীকে জেরাও তার সংশ্লিষ্টতার দিকে ইঙ্গিত করে।

মেয়েটিকে হত্যার আগে শেষ বারের মতো ধর্ষণ করতে চেয়েছিলো স্পেশাল পুলিশ অফিসার দিপক খাজুরিয়া। কিশোরের জবানবন্দীতে তার নাম আসে। কল ডাটা রেকর্ডও ঘটনাস্থলে তার উপস্থিতির প্রমাণ দেয়।

চতুর্থ অভিযুক্ত, আরও একজন স্পেশাল পুলিশ অফিসার সুরিন্দার কুমার। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে ক্রাইম সিনে দেখেছে। কল ডাটা রেকর্ডও তার উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়।

কিশোর তার বন্ধু প্রাভেশ কুমারের নামও নেয়, সে পঞ্চম অভিযুক্ত। মেয়েকে বারবার ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের একজন সে।

সাঞ্জি রামের ছেলে ভিশাল জাগোত্রাকে ফরেনসিক পরীক্ষার ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিশাল মিরুতে পড়াশোনা করে, তাকে ফোনকল করে কিশোরটি জানিয়েছিলো তুমি তোমার ‘লালসা মেটাতে পারো’ আর তা শুনেই সে কাঠুয়াতে আসে।

পুলিশের আরও দুইজন অভিযুক্ত, যারা এই ভয়ানক অপরাধ সম্পর্কে জানতো এবং বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলো। সাব ইন্সপেক্টর আনন্দ দত্ত এবং হেড কনস্টেবল তিলক রাজ গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করেনি। অভিযুক্তদের সাহায্য করার জন্য মেয়েটির পোশাক ধুয়ে দিয়েছিলো তারা।

সুপ্রিম কোর্ট
বৃহস্পতিবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন: আইনজীবীরা আইনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না এবং এটা বিচার প্রাপ্যতার লঙ্ঘন।

আসিফা বানুর ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগপত্র দায়েরে আইনজীবীদের বাধাদান ও আক্রান্তর পরিবারকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ দাবি করে আইনজীবীদের একটি গ্রুপের দায়ের করা পিটিশনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্ট এমনটি বলেন।

শুনানিতে অভিযুক্তদের পক্ষে কাঠুয়া ও জম্মুর বারের আইনজীবীরা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে বলে ভারতের প্রধান বিচারপতি দিপক মিশ্রার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চকে এমনটি বলা হয়।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে নিরাপত্তা জোরদারের মধ্যেও চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে কাঠুয়া বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবীরা কোর্ট প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করে এবং ক্রাইম ব্রাঞ্চ কর্মকর্তাদের কোর্টে প্রবেশে কয়েক ঘণ্টা বাধা দেয়। পরে আরও নিরাপত্তাকর্মী পাঠানো হলে ক্রাইম ব্রাঞ্চের কর্মকার্তরা অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করেন।

কাঠুয়া বার অ্যাসোসিয়েশন মূলত হিন্দু একতা মঞ্চের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে ক্রাইম ব্যাঞ্চের তদন্তকে পক্ষপাতমূলক বলে এর বিরোধীতা করে। সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্ত চায় তারা।
ক্রাইম ব্রাঞ্চের তদন্ত পর্যবেক্ষণ করে জম্মু কাশ্মিরের হাইকোর্ট।

কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি
ধর্ষণের বিচার চেয়ে বিরোধী দল কংগ্রেসের বিক্ষোভ রাজনৈতিক বলে অভিযোগ তুলেছেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। কেন্দ্রের দ্বিতীয় নারী মন্ত্রী হিসেবে তিনি এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য করলেন। “একজন নারী হিসেবে, আমি আক্রান্তকে অপমান করা বন্ধ করার আহ্বান জানাই। ”

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী মানেকা গান্ধী সকালে এক ভিডিও বার্তায় জানান, তিনি অত্যন্ত মর্মাহত এবং শিশু ধর্ষণের দায়ে জড়িতদের জন্য মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আইন সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিবেন।

স্মৃতি ইরানি
স্মৃতি ইরানি

 

গত রাতে রাহুল গান্ধী ইন্ডিয়া গেটের কাছে এক বিক্ষোভ মিছিল থেকে আসিফার হত্যার ন্যায়বিচার দাবি করেন। ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং রাজ্য দুটিতে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে লক্ষ্য করেই তার এই বিক্ষোভ।

তিনি বলেন, যখনই আমরা দেখি নারী শিশু ধর্ষিত ও হত্যার শিকার হচ্ছে আমরা চাই সরকার পদক্ষেপ নিক। এটা একটি জাতীয় ইস্যু, রাজনৈতিক নয়।

মানেকা গান্ধী

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী মানেকা গান্ধী
প্রটেকশন অব চিল্ড্রেন অ্যাগেইন্সট সেক্সুয়াল অফেন্সেস অ্যাক্ট সংশোধনের কথা বলেছেন মানেকা গান্ধী।
মানেকা বলেন, ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে এই সংশোধন করা হবে। ইউটিউবে পোস্ট করা ভিডিও বার্তায় এমনটি বলেন।

 

ধর্ষণে অভিযুক্তদের পক্ষে আন্দোলন
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই ঘটনার অভিযুক্তদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ, গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই হিন্দু আর বাকারওয়ালরা মুসলিম। এই মামলা তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের কয়েকজনও মুসলিম। হিন্দু অ্যাক্টিভিস্টদের দাবি, ‘এদের বিশ্বাস করা যায় না।’