বছর দুয়েক আগের কথা। বাসার পাশে সিটি কর্পোরেশন কর্মীরা রাস্তায় কোন একটা কাজ করছেন। এরকম কাজে মাঝেমধ্যেই কর্মীদের অলসতা পেয়ে বসে। তাদের কেউ বিড়ি-সিগারেট খান, কেউ গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে পড়েন। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম, সর্দার গোছের একজন বলছেন: ঠিকঠাক কাজ কর। নাইলে মেয়র নিজেই কিন্তু আইয়া পড়ব।
তার কিছুদিন আগে ঢাকা উত্তরের মেয়র হয়েছেন আনিসুল হক। আমি যেখানে থাকি সে এলাকাটা উত্তরে পড়েছে। মেয়র নিজেই কাজ দেখতে চলে আসতে পারেন বলে ওই সর্দার কর্মীদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছেন তিনি আনিসুল হক। তাদের ভয় থেকে এটা স্পষ্ট যে নতুন মেয়র তাদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এমন বার্তা দিয়ে রেখেছেন যেখানে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।
হোক কিছুটা বিতর্কিত নির্বাচন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বি প্রধান প্রার্থীর পরিবারের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা বেশি, কিন্তু নির্বাচনের আগে থেকেই আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে আনিসুল হক নির্বাচিত হওয়া মানে ঢাকা মহানগরী তার ইতিহাসে সেরা মেয়র পাবে। তিনি নির্বাচিত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আমরা সেটা টের পেয়েছি।
সাত রাস্তার অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে রানওয়ের মতো রাস্তা করে দেওয়া কিংবা গাবতলী বাস স্ট্যান্ড বেদখল থেকে মুক্ত করা কিংবা বিলবোর্ড অপসারণের মতো তার বড় বড় সাহসের বিষয় আমরা সবাই জানি। আমি অবশ্য নিজের এলাকা দিয়ে তাকে অন্যভাবেও চিনেছি যেখানে উন্নয়নের সঙ্গে মিশে ছিল সৌন্দর্য, শিল্প এবং নাগরিকবোধ।


তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শুধু বাসার চারপাশের রাস্তাগুলোই ঠিক হয়ে গেলো এমন না। রাস্তার দু’পাশে ফুলের সমারোহও বসলো। কর্পোরেশন নিজে কিছু টব বসিয়ে দিলো, নগরবাসীকেও উৎসাহ দিলো যেন বাড়ির সামনেটা সবাই সুন্দর রাখে। পথে যেন ময়লা পড়ে না থাকে সেজন্যও কিছু দূরে দূরে বিন বক্স বসানো হলো। এর সবই যে সফল হয়েছে এমন না, বিশেষ করে যেখানে নগরবাসীর নিজেদের অংশগ্রহণের বিষয় ছিল সে জায়গাটায় পুরোপুরি সাফল্য আসেনি। এটা আনিসুল হকের ব্যর্থতা নয়, এটা আমাদের ব্যর্থতা; নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বহীনতা।
তবে, পরিচ্ছন্নতার জায়গায় কর্পোরেশন তার কাজ ঠিকই করে গেছে। আবারও বাসার পাশের একটি উদাহরণ দেই। আমি যেখানে থাকি তার কাছাকাছি একটা সরকারি হাসপাতাল আছে যেখান থেকে মূলত: মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। কয়েক বছর আগে এক আত্মীয়র বাচ্চা হওয়ার সময় আমরা সেখানে যাবো কিনা ভাবছিলাম। যাওয়া হয়নি তার কারণ ওই হাসপাতালটির সামনে এক বিশাল ভাগাড়। এলাকার সব গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে সেখানে রাখা হয়। সেখান থেকে কর্পোরেশনের গাড়ি আবর্জনা নিয়ে যায়। অবস্থা এমন ছিল যে গন্ধের জন্য ওই এলাকা দিয়ে যাওয়াই সমস্যা।
অবস্থা এমন হওয়ার কারণে তখন ওই হাসপাতালে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারিনি। কিন্তু, এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আনিসুল হক মেয়র হওয়ার পর বছর দুয়েক আগে প্রথমে ওই ভাগাড়টি ঢেকে ফেলা হয়, পরে সেখানে গড়ে তোলা হয় একটি বাগান। এখন চাইলে ওই বাগানে গেলে আপনি না জানলে বুঝতেও পারবেন না যে এর ভেতরে একটি ভাগাড় আছে।
এসব কাজ যে মেয়র আনিসুল হক নিজ হাতে করে দিয়েছেন এমন না। কিন্তু, পরিবর্তনটা হয়েছে। সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? সম্ভব হলো এক. তার ‘গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা’র স্বপ্ন বাস্তবায়নের রূপরেখা এবং দুই. তার সম্পর্কে এমন ধারণা যে এখন আর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করে বসে থাকা কিংবা টাকা গায়েব করে দেওয়া সম্ভব না।
মেয়র আনিসুল হক সেই কর্মউদ্যোগী কর্মীমানুষ ছিলেন যিনি শুধু মুখে স্বপ্নের কথা বলেননি, স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুধু কাগজে-কলমে পরিকল্পনা করে বসে থাকেননি। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েছেন, অন্যদেরও উদ্যোগী করেছেন। এ কারণে তিনি নিজের ব্যবসায় যেমন সফল, তেমনি মেয়র হয়ে সিটি কর্পোরেশনের কাজেও সেই সাফল্যের পথে হাঁটছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য মেয়র হিসেবে কাজের সিকিভাগ করার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার মতো সফল মানুষ আরেকজন পাওয়া খুব কঠিন।
উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের চারপাশে অনেক সফল মানুষ আছেন। রাজনীতি করেন এবং মেয়র হতে চান এরকম মানুষের সংখ্যাও অনেক। সংস্কৃতির যে অঙ্গনে আনিসুল হকের বিচরণ ছিল সেখানেও অনেক সফল মানুষ আছেন। কিন্তু, সবগুলো গুণ একসঙ্গে হবে এরকম দ্বিতীয় আরেকজন আনিসুল হক কোথায়? সব দল, সব মত, সব পথের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন এরকম আরেকজন আনিসুল হককে আমরা কোথায় পাবো?
আমরা সবাই জানি, আনিসুল হক একজন স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন। এ দেশে তিনি একাই কি স্বপ্নবান? না, এরকম আরো অনেকে আছেন। কিন্তু, ক’জন তার মতো সাহসী? ক’জন চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন? ক’জন উদ্যোগী হন? ক’জনকে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর মানুষটি বিশ্বাস করে দায়িত্ব তুলে দিতে পারেন? আনিসুল হক আসলে একজনই ছিলেন। তাকে চিনতে পেরেছিলেন বলেই তাকে মেয়র করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া দায়িত্বের প্রতি সম্মান রেখেই বিদায় নিয়েছেন আনিসুল হক। আমরা আর কখনোই হয়তো আরেকজন আনিসুল হককে পাবো না।
তবে, তিনি যদি মেয়র না হতেন তাহলেও এদেশ তাকে মনে রাখতো। টেলিভিশনের পর্দায় অনুষ্ঠান করে তিনি ছিলেন একজন নায়ক, সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তরুণদের কাছে তিনি ছিলেন অনুকরণীয়, বেসরকারি খাতের বিকাশে ব্যবসায়ীদের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন এক আদর্শ।
আনিসুল হক টিভির পর্দায় আমাদের আনন্দ দিয়েছেন, ব্যবসায়ী হিসেবে তরুণদের পথ দেখিয়েছেন, মেয়র হিসেবে পরিবর্তনে সাহস যুগিয়েছেন। এ সব কিছুই তিনি পেরেছেন কারণ স্বপ্নবান আনিসুল হক শুধু মননশীলই ছিলেন না, তিনি সৃজনশীলও ছিলেন; স্বপ্নবান আনিসুল হক শুধু স্বপ্ন দেখাননি, স্বপ্নের পথে হাঁটার পথটাও দেখিয়েছেন। তিনি শুধু উন্নয়নই দেখেননি, সেখানে সৌন্দর্যটাও দেখেছেন, সবকিছু সুন্দর করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তার নাগরিক চিন্তাবোধের সঙ্গে সবসময়ই মিশে ছিল সৌন্দর্য। তিনি আসলে এক শিল্পী ছিলেন যে শিল্পী আমাদের নাগরিক করে সুন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন স্বপ্ন, উদ্যোগ এবং উন্নয়নের এক কবি। তার মেধা, যোগ্যতা, উদ্যোগ, সৃজনশীলতা, সৌন্দর্যবোধ, শিল্পীমন ও সাহসের কারণে আনিসুল হককে মনে রাখবে বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)