‘অভিবাসী কোন মানুষ কখনও অবৈধ হতে পারেনা। বিশ্বের কোথাও। যথাযথ কাগজ না থাকলে আনডকুমেন্টেড বলা যেতে পারে তাকে। বলা যেতে পারে তাকে কাগজহীন মানুষ। অবৈধ নয়।’ পরম মমতায় বলছিলেন বছর চল্লিশের বাংলাদেশি কোরিয়ান যুবক শেখ আল মামুন। দক্ষিণ কোরিয়ায় আছেন ২০ বছর ধরে। ১৩ বছর ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক।
তার নিজের ট্যুরিস্ট ভিসায় কোরিয়ায় আসা এবং কাগজহীন অভিবাসী হয়ে পড়ার ঘটনাও চমকপ্রদ। তারপর অভিবাসী সুরক্ষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিযাত্রা। সেটিও কম অনুপ্রেরণার নয়।
১৬০০০ বাংলাদেশি রয়েছে ৫ কোটির দক্ষিণ কোরিয়ায়। তার মধ্যে আড়াই থেকে তিন হাজার কাগজহীন বাংলাদেশি। কোরিয়া দ্বীপে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাগজহীন অভিবাসীর সংখ্যা ৫ লাখ। এই সব অভিবাসীর স্বার্থ রক্ষায় ২০০৫ সালে তৈরী করেছেন মাইগ্রেন্ট ট্রেড ইউনিয়ন। সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি তিনি। কমিটির একমাত্র বাংলাদেশি সদস্য। নেতৃত্বে আসার আগে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। আর এই অভিবাসী সুরক্ষা সংগ্রামে এমনি এমনি তো জড়িয়ে পড়েননি। বরং এটি অনিবার্য ছিল। কারণটা জানতে তার কোরিয়ায় আসার প্রেক্ষাপট জানতে হবে।
তখন শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজে ম্যানেজমেন্টে অনার্সে ভর্তি হয়েছেন। যদিও তার পড়াশোনার ইচ্ছা নেই। বাবার চাপে ভর্তি হওয়া। তবে মাকে বুঝিয়ে তার মাধ্যমে বাবাকে রাজি করিয়ে আড়াই লাখ টাকায় দালালের মাধ্যমে ৬ মাসের ট্যুরিস্ট ভিসায় কোরিয়া উপদ্বীপের দক্ষিণে যাত্রা। এক আত্মীয় থাকতেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। তার কাছে থেকে কাজ নিলেন। সেসময় নিয়ম ছিল অভিবাসী কোন শ্রমিক একবছর কোন কাজ করলে সে বাড়তি একমাসের বেতন পেত। কিন্তু মামুনের বেলায় তা ঘটেনি। তখন মামুনের পাশে এসে দাঁড়ায় ইক্যুয়েলটি ট্রেড ইউনিয়ন এর মাইগ্রেন্ট শাখা। তাঁর প্রাপ্য আদায় করে দেয় তারা। তখন ইউনিয়নের গুরুত্ব বুঝতে পারে মামুন। সেই সংগঠনের ডাকে এক অনুষ্ঠানে একটি কোরিয়ান গান শুনে বিক্রমপুরের মামুন। যার লাইন ছিল ‘আমি একদিন বাঁচলেও মানুষের মত বাঁচি/ মানুষের জন্য বাঁচি’। গানটি তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান নির্দিষ্ট করে দেয়। নিজের জীবন অভিবাসীদের সুরক্ষায় সঁপে দেন পেশাদার সিনেমা নির্মাতা মামুন।
এখনে আন্দোলন চলছে অভিবাসীদের জন্য তিন দফা নিয়ে। দফাগুলো হল কাজের অনুমতি পদ্ধতি ঠিক করা, যাদের কাগজ নেই তাদের কাজ দেওয়া এবং অভিবাসীদের ধরপাকড় বন্ধ করা।
চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম দিন তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উৎসব শুরুর অনুষ্ঠানে। জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে। আবার দেখা হল ৯ দিন পর। উৎসবের শেষ দিন। সেই জাদুঘরে। মূল মিলনায়তনে। উৎসবে কেন বাংলাদেশি এই কোরিয়ান নাগরিক? সহজ উত্তর, তার চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে এই চলচ্চিত্র। উৎসবের শেষ সন্ধ্যায় গণগ্রন্থাগর মিলনায়তনে প্রদর্শিত হয়েছে ৬৭ মিনিটের ‘জার্নি ইনটু দ্য ড্রিম’। এক কথায় বলা যেতে পারে স্বপ্নযাত্রা। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।
২০১৩ সাল থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের হাতেখড়ি। ২০১৬ এর আগ পর্যন্ত ৭টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। একটি গল্প ঠিক করে ইআইডিএফ (ইবিএস ইন্টারন্যাশনাল ডকুমেন্টারী ফান্ড) এর জন্য আবেদন করে মিলে যাওয়াতে স্বপ্নের পরিধি বাস্তবায়নের বাস্তবতা তৈরী হয়। ১৫ লক্ষ টাকার মত মেলে সেখান থেকে। বাংলাদেশে জলজ মুভিজ বাকী প্রযোজনায় সহায়তা করে। অভিবাসী যন্ত্রনা এবং স্বপ্নের স্বপ্নযাত্রার পথচলা শুরু হয়। যা পূর্ণতা পেয়েছে নিজের জন্মভূমির চলচ্চিত্র উৎসবে এসে।
ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি ঘরোয়া উৎসবে অংশগ্রহণ এবং ইবিএস টেলিভিশনে প্রদর্শিত হলেও মামুনের তৃপ্তি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ। এবার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। বিষয়ও ঠিক হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থায়ী হয়েও জন্মভূমির প্রতি টান এবং কাতরতা চলচ্চিত্রের বিষয়।
বিয়ে করেছেন কোরিয়ান এক নারীকে। ভালোবেসে। ২০০৪ সালে। সেও এক দারুন গল্প। ইন্টারনেটে বাবা-মাকে দেখালেন। বাবার একটু দ্বিধা থাকলেও মায়ের পছন্দ ছিল বেশি। তারপর দেশে আসলেন হান জুং গিয়ংকে নিয়ে। সে সময় মা অসুস্থ ছিল মামুনের। ভিনদেশি মেয়ে হাসপাতালে নিজের মনের টানে যেভাবে তার মায়ের সেবা করেছেন সেটা তার বাবার দ্বিধা পুরোটাই কাঁটিয়ে দেয়।
মামুনের বাবা বেঁচে আছেন। তবে মা পৃথিবীর মায়া ছেড়েছেন। এখন ৩ ভাই ১ বোনের মধ্যে মেজ মামুনের জীবন জুড়ে পুরোটাই কোরিয়া। অভিবাসী আর সিনেমা। জাপান, মংগলয়িা, নেপাল, কোরিয়া এবং বাংলাদেশের সদস্য মিলে তৈরী করেছেন এশিয়া মিডিয়া কালচার ফ্যাক্টরী। অভিবাসীর যন্ত্রণার অবসানে সংগ্রাম আর সিনেমা অভিবাসী জীবন নিয়ে শিল্পের ভাষায় লড়াই এই তার দিনমান।