হাওরের পানি পরীক্ষা করে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সুনামগঞ্জের হাওরের পানিতে প্রাথমিকভাবে তেজস্ক্রিয়তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গত কয়েক দিন ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আর সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া মৃত হাঁস আর মরা মাছের ছবি দেখে যে ভয় জন্মেছে, বিজ্ঞানীদের এই বক্তব্য কিছুটা হলেও প্রশান্তি নিয়ে এসেছে। সত্য যখন জানা যায় না, বিজ্ঞানের প্রয়োগ যেখানে স্বচ্ছভাবে হয় না, তখন ‘ষড়যন্ত্র’ আর ‘গুজব’ এর ডালপালা বড় হতে থাকে।
তারপরেও কিছু প্রশ্ন মনের মধ্যে খচখচানি রয়েই যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমরা কি তাহলে নিরাপদ? প্রথমেই মনে আসে, ৪ হাজার হাঁস আর কয়েক হাজার টন মাছ তাহলে কিভাবে মারা গেলো?
মফস্ফলের ছেলে হিসেবে ছেলেবেলা থেকে হাঁসকে জেনে এসেছি খুবই শক্ত প্রাণের প্রাণি হিসেবে। মাছের মধ্যে কৈ-মাছ আর গৃহপালিত প্রাণির মধ্যে হাঁসের প্রাণ ধীরে ধীরে যায়। দেশের হাওরের হাঁসসহ বিভিন্ন পাখি সুদূর সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন শীতের দেশ থেকে মাসের পর মাস উড়ে আমাদের দেশে এসেছে/আসে/আসবে। সেই শক্তপ্রাণের প্রায় ৪ হাজার হাঁস হঠাৎ করে একসাথে কীভাবে মারা গেলো? এক-দুদিনের মধ্যে হঠাৎ করে হাজার টন মাছ কেনো মরে গেলো?
হাওরের পানি পরীক্ষা করতে ওই এলাকা ঘুরে আসা পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ‘স্বাভাবিক পরিবেশে ০.২০ মাত্রার ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা থাকে। সেক্ষেত্রে হাওরে রয়েছে ০.১০ মাত্রা, যা প্রায় অর্ধেক।হাওরের ধান পচে ও ধানে সার প্রয়োগের ফলে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এই মাছ মারা যেতে পারে।’ নিশ্চিতভাবে কিছু বলেননি তারা। নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার পরে নিশ্চিত কারণ জানাতে সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তারা। হাঁস মারা যাবার বিষয়ে তারা কিছু বলেনি। কিছু অসমর্থিত সূত্রে অবশ্য হাঁসের মৃত্যুর জন্য মরা মাছ খেয়ে ডায়রিয়া নয়তো ডার্কপ্লেগ রোগকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরমানু বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয়তা না পেলেও জেলা-উপজেলার মৎস কর্মকর্তারা এক সপ্তাহ মাছ না ধরতে নিষেধ করেছে, এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কেনো মাছ মারা যাচ্ছে, তা অবশ্য পরীক্ষা ছাড়া জানানো যাবে না বলে জানিয়েছেন ওই মৎস কর্তারা।
পরমানু বিজ্ঞানীরা ‘প্রাথমিক পরীক্ষা’ করে যে ‘ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা নেই’ ঘোষণার খবর বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঈদের চাঁদ দেখার মতো করে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। অথচ কেউ খুঁজতে জাননি, প্রাথমিকভাবে কীভাবে বলে দেয়া যায় যে ‘তেজস্ক্রিয়তা নেই’, এটা কী ফরমালিন টেস্টের মতো কোনো বিষয়? ফরমালিন টেস্টওতো বেশ সময় সাপেক্ষ ছিলো যখন ফরমালিন নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। পরে সায়েন্স ল্যাব কর্তৃপক্ষ কয়েকমাস পরে সহজলভ্য কিট বের করে ফরমালিন পরীক্ষার জন্য। ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা মাপার পদ্ধতি কী ওইরকম কোনো কিট দিয়ে করেছিলেন?
বিষয়টি নিয়ে একটু গুগল করে কানাডাসহ বিভিন্ন উন্নত দেশের মাইনিং নিকটবর্তী খাবার পানি বিষয়ক বেশ কয়েকটি লিংক পেলাম। ওখানে পরিষ্কার বলা আছে, শুধুমাত্র ল্যাবে পরীক্ষার পরেই বলা যাবে পানিতে কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা আছে। পরীক্ষাটি একটু সময় সাপেক্ষ এবং ২০ থেকে ২৫ ডলারের কিট দিয়ে তা সাধারণ জনগণও পরীক্ষা করতে পারেন। তবে দেশের পরমানু বিজ্ঞানীদের মতো তারাও বলেছে স্বাভাবিক পরিবেশে ০.২০ মাত্রার ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তা থাকে। ওইমাত্রার ইউরেনিয়ামে ভয়ের কিছু নেই। ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহতার নানা ক্ষতিকর দিক নিয়ে হাজার হাজার সাইট ও লিংক আছে, সেগুলো আর বেশি ঘাটতে গেলাম না! ওগুলো বোঝার জন্য পরমানু, পরিবেশ, মৎস-প্রাণি বিজ্ঞানীরা আছে।
ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তার যে বিষয় ও আশঙ্কা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আমারও চিন্তা হচ্ছে এবং আমার বোঝার-আস্থার অভাব ওই ‘প্রাথমিক তদন্ত’ পদ্ধতি নিয়ে। হুট করে কেনো তারা স্টেটমেন্ট দিয়ে দিলেন? ওতোগুলো মরা মাছ কী হবে/হয়েছে/হচ্ছে? কয়েক হাজার টন মাছ কি হাওর হয়ে ঢাকার বাজার দিয়ে আমার আপনার বাসায় ঢুকে পড়ছে? ওই মাছ খাওয়া কী নিরাপদ? কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা আছে কি? ওই এলাকার ডুবে যাওয়া ধান, জলজ উদ্ভিদ গবাদি পশুর খাদ্য হলে ক্ষতি কী হতে পারে? হাওরের খাদ্যচক্রে উৎপাদিত খাদ্যে ওই ‘গুজব’ তেজস্ক্রিয়তা দেশের এমপি-মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টসহ দেশের জনগণের পেটে যাচ্ছে কী?
এই বিষয়গুলো কে ভেবে দেখছে? পাঠক, হয়তো ভাবছেন ‘এতো চিন্তার কী আছে? কেউ না কেউতো আছে!’… আপনাদের চিন্তাই সত্য হোক। হাওরের মৃত হাঁস আর মরা মাছে তাহলে নিরাপদ, চিন্তার মনে হয় আসলেই কিছু নেই!!!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)