প্রয়াত সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিন। একাত্তরের শব্দসৈনিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিবেদিত ছিলেন তিনি তাদেরই একজন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি বার্তা বিভাগে (ইংরেজি) কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে দেশের জন্যে নিষ্ঠা ও আস্থার সাথে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবাদিকতা পেশাতেই তিনি নিবিষ্ট ছিলেন। সর্বশেষ ইংরেজি ডেইলি বাংলাদেশ অবজারভারে সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি জাতীয় প্রেক্লাবেরও সহযোগী সদস্য ছিলেন।
২০০৫ সালের ১১ জুন কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের সন্তান সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিন অসুস্থ হয়ে ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসাতে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি রেখে যান দুই সন্তান মেহের জালাল নোভা এবং ফুয়াদ জালালকে।
সর্বশেষ গতবছরের নভেম্বরে শব্দসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে যে ১০৮ জনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকা প্রকাশ করা হয় সেই তালিকাতে প্রয়াত এই শব্দসৈনিকের নাম নেই। তালিকায় নাম না থাকায় প্রয়াত সাংবাদিক জালাল উদ্দিনের স্ত্রী তাহেরা বেগম এবং তার সন্তানেরা যুগপৎ হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন বই, গবেষণা গ্রন্থ, দলিল দস্তাবেজে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে তার নামটি উল্লেখ করা আছে।
শুধু এই নয় ২০০০ সালের ৭ অক্টোবর প্রকাশিত সাপ্তাহিক মুক্তিবার্তা ৪৫ তম সংখ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয় সেখানেও তার নাম উল্লেখ রয়েছে। মুক্তিবার্তাতে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী তার মুক্তি নং ০২০৪০৫০৮৯৪। অুসন্ধানে দেখা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যারিষ্টার কামাল হোসেন সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিনকে একটি প্রত্যয়নপত্র (এপ্রিল ১০, ১৯৭৩ইং) প্রদান করেন।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, ‘ডিউরিং দ্য ওয়ার অফ লিবারেশন হি ওয়াজ ইন চার্জ অব দি ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ ব্রডকাস্ট অফ দ্য ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ এন্ড ইন দ্যাট ক্যাপাসিটি কভারড সেভারেল ফরওয়ার্ড এরিয়াস।’ একইভাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ভাইস চেয়ারম্যান (প্রশাসন), এম.এ. রশীদ এবং মহাসচিব (প্রশাসন) গত ৩৪১/১০/২০০০ দ্বারা প্রত্যয়ন করেন যে, এ. এক. এম. জালাল উদ্দিনের স্ত্রী তাহেরা বেগম একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী।
সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বার্তা বিভাগে (ইংরেজি) কর্মরত ছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে সেসময় আরও কর্মরত ছিলেন কামাল লোহানী, সুব্রত বড়ুয়া, আবুল কাশেম সন্দীপ, হাসান ইমাম, বাবুল আখতার, মৃণায় রায়, পারভীন হোসেন, ফিরোজ আখতারসহ আরও অনেকে। সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিন ছাড়া অন্য সবাইই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। গতবছরের নভেম্বরে কামাল লোহানী, সমর দাস, সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, শেখ সাদী খান, আব্দুল জব্বার খান, হালিমা জব্বারসহ ১০৮ জন শব্দসৈনিককে মুক্তিযোদ্ধার নাম গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এর আগে ৮৭ জন শব্দসৈনিককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
মুক্তিযুুদ্ধের বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজে মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিক হিসেবে তার যে অবদান সেটা উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে শামসুল হুদা চৌধুরীর লেখা আহমদ পাবলিসিং হাউজ থেকে প্রকাশিত একাত্তরের রণাঙ্গন বইটির ৭৪ পৃষ্ঠায় যেসব শব্দসৈনিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিনের সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এএসএম শামসুল আরেফিনের লেখা মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান শীর্ষক বই-এর ৯১ নম্বর পৃষ্ঠাতেও তার নাম এবং ক্রমিক নম্বর সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
৭২ সালের ১ মে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে যে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয় সেখানেও ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এস.কে সাহা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, ডিউরিং দ্যা ওয়ার অফ লিবারেশন হি রেন্ডার্ড ইউসফুল সার্বিস টু দ্য ফ্রি বাংলাদেশ রেডিও এস ইটস ওয়ার করসপন্ডেন্ট।
প্রয়াত এ.কে.এম জালাল উদ্দিন ১৯৬৯-৭০ সালে রাকসুর জিএস (ছাত্রলীগ সমর্থিত) ছিলেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বাণিজ্য মন্ত্রী এবং তৎকালীন ছাত্রনেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ এর নেতৃত্বে গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। সে সময় আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র ছাত্রীদের বর্বর পাকিস্তানী পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি এবং শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন এবং দুঃখজনকভাবে সেখানেই অধ্যাপক শামসুজ্জোহা গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন।
তার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী ‘ শেখ হাসিনা’ এক শোক বিবৃতিতে ষাটের দশকের ছাত্রনেতা হিসাবে বিভিন্ন প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদানের কথা স্বীকার করেন।
শব্দসৈনিক, সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিনের মেয়ে মেহের জালাল নোভা জানিয়েছেন তাদের পরিবারের পক্ষ হতে এই স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এর সাথে ব্যক্তিগত স্বাক্ষাত করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও দালিলিক প্রমাণাদি স্বহস্তে হস্তান্তর করেছেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ও গণ আন্দোলনে তার বাবার জোরালো ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে শব্দ সৈনিকদের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয় তাতে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ বিষয়ে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘জননেত্রীর কাছে এই সত্য তুলে ধরার পেছনে অর্র্থনৈতিক লাভ এবং অন্য কোন প্রকার সুবিধা প্রাপ্তির উদ্দেশ্য নয়, শুধুমাত্র একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে পিতার স্বীকৃতিটাই কেবল চাই, অন্যকিছু নয়। এই স্বীকৃতিটুক পেলে পিতার যথার্থ মূল্যায়নটা করা হবে।’
এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক প্রবীণ সাংবাদিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেছেন এ.কে.এম জালাল উদ্দিন তার অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন। কিন্তু শব্দসৈনিকের তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়াটা খুবই দুঃখজনক। কামাল লোহানীও মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রয়াত সাংবাদিক এ.কে.এম জালাল উদ্দিনকে শব্দসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)