পৃথিবীতে কিছু কিছু নাম আছে যেগুলো উচ্চারণের দৃশ্যপটে ভেসে আসে বিশাল এক জগত। যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাম উচ্চারণে পর আর কিছু বলতে হয় না। কোথা থেকে যেন নাট্য সংলাপ এসে আপনাকে ব্যাকুল করে তুলবে। “Oh teach me how I should forget to think”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; এই নামটি একবার উচ্চারণ করে দেখুন চারিদিক থেকে ধেয়ে আসবে প্রেম-পূজা-প্রকৃতি ও দেশ।
আরো একটি নাম আছে, তবে সেটা হয়তো শুধু নাম কিংবা শিরোনাম নয়। হয়তো গদ্য-পদ্যের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে থাকা একটি ঝলক। এক সময় সরকারী বাধা নিষেধ ছিল সেই নামটি উচ্চারণে তবে বর্তমান যুগে তাঁর নাম মুখ ফুটে বলার আগেই উচ্চারিত হয়ে যায়। কথাতে-ইঙ্গিতে-উপমা-ভঙ্গিতে তাঁর উপস্থিতি সদা অনুভূত হয়। পাজামা-পাঞ্জাবির উপর হাতকাটা কালো কোটের কথা চিন্তা করে দেখুন। সেটা যাকে মানায় ভাল সেই ব্যক্তিটির ছবি এসে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে যাবে। তাঁর নাম নীরবতার মাঝেও উচ্চারিত হয় বাঙালির হৃদয়ে।
আপনি বলুন টুঙ্গিপাড়া, কিংবা বাংলাদেশ। অথবা বলুন ভাইয়েরা আমার। বলুন আমার দেশের গরিব দুঃখী মানুষ, বলুন ইনশাল্লাহ …কোন রাখঢাক ছাড়াই নামটি উচ্চারিত হয়ে যায়।তার একটি মোটা ফ্রেমের চশমা ছিল। তেমনি ছিল একটি পাইপ। এরিনমোর ব্যান্ডের তামাক খেতেন তিনি। প্রিয় মাছ ছিল কৈ। ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মার্চ যেকোনো মাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আরো দেখুন ১৯৭১ সাল। তিনি সবখানেই আছেন। ১৯৭৫ থেকে তিনি তো আছেন বিন্দুতে, সাগরে।
কিছু কিছু সাধারণ কথা যা আপনি আমি সব সময়ই বলতে পারি যেমন ধরুন ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল’ এমন অনেক কথাই এখন তার কথা হয়ে গেছে। বাংলা ভাষার অগণিত শব্দমালায় মিশে আছেন তিনি। তাঁর অস্তিত্ব বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আলো-বায়ু রোদ-বৃষ্টি সব কিছুর সাথে একাকার হয়ে গেছে। বাঙালির জন্য অনেক বড় একটা শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়েছিলেন তিনি। অথচ এই বিশাল মানুষটি অজ্ঞাত এক হাবিলদারের গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন নিজ বাড়ির সিঁড়ির উপর।
এই বিয়োগান্ত ঘটনার কথা মনে এলে প্রথমেই মনে পড়ে সেই হাবিলদারের কুৎসিত নাম। তারপর আসে কিছু ক্যাপ্টেন, কিছু মেজরের কথা। এদের সাথে জড়িত ছিল আরো কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি। পক্ষ দুটি, একদিকে শোষিত দলের সদস্য হয়েও যিনি শোষককে শাসিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে’।
অন্য পক্ষ- লাটিমের রশিতে বাংলাদেশকে ঘুরানো একদল খেলোয়াড়। শেষের পক্ষ দায়িত্ব নিয়েছিল বাংলাদেশীদের ‘বাঙালি’ হবার ডানা কেটে দিতে। বাংলাদেশকে নিয়ে যেমন খুশি তেমন করে খেলবে এই ভেবে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অপবিত্র কাজ। তারা নানা কথার বুলি ছুড়েছিল ১৯৭৫ এ। পানি দিয়ে পাথর গলঃধকরণের মত করে বোঝাতে চেয়েছিলেন দেশের জন্য কোন নেতার দরকার নেই দরকার শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তারা সীমাহীন মিথ্যা প্রচার ও ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল যেন দেশবাসী যাকে নেতৃত্বের উচ্চ আসনে বসিয়েছিল সেখান থেকে তারা তাকে সরিয়ে দেয়।
বলা হতো তোমাদের নির্ধারিত নেতা তো শুধু নিজের এবং পরিবারের কথা বলতেন। দেশকে ২৫ বছরের চুক্তি করে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন করার পেছনে তার কিছুই করার ছিল না। তিনি তো স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে আরামেই কাটিয়ে ছিলেন দিন। তাদের এই বুলি কেউ বিশ্বাস করে নি। বিদ্যালয়ের বালককেও তারা বোঝাতে বিফল হয়েছিল বরং এই অপপ্রচারকে সন্দেহের চোখে দেখে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছিল সত্যের পক্ষের মানুষ। ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম’ যার, তাকে দেশের মানুষ তার মৃত্যুর পর আরো বেশি খুঁজতে শুরু করে। বুঝতে সময় লেগেছে অনেকগুলো বছর কিন্তু সাধারণ মানুষ বেশিদিন জুজুর ভয়ে ভীত হয়ে থাকে নি।
আজ এত যুগ পরেও তার নাম উচ্চারণ করতেই একটি দেশের মানচিত্র ভেসে ওঠে। আজ বাংলা ভাষায় কথা বললে তার কথা মনে পড়ে সবার আগে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাট বাজারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ দেখা মাত্রই গর্জন শোনা যায়, ‘কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না’। এই জেগে ওঠা জনগোষ্ঠীকে ঠেকাতেই একদিন হাবিলদারের হাতে স্টেনগান তুলে দিয়েছিল কিছু মেজর এবং ক্যাপ্টেন। নিজ জাতি, নিজ ভাষা, নিজ দেশের বিরুদ্ধে এতো বড় ষড়যন্ত্র হয়তো অন্য কোন দেশে পাওয়া যাবে না। একজন নেতাকে হত্যা করে একটি দেশের উন্নয়নের ক্ষমতা রহিত করা যায় না। এ কথা দেরিতে হলেও পরিকল্পনাকারীরা আজ বুঝতে পেরেছে।
তাদের সব চেয়ে বড় ভুল হয়েছিল নেতার প্রতি আঘাত করা। ভুল এই কারণেই যে একজন মানুষ একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে কিন্তু একজন মানুষ হত্যা করে একটা জাতিকে শেষ করা যায় না। এই ক্যাপ্টেন মেজর হাবিলদারদের প্রভুরা অবশ্য অন্য পথ ধরেও এগিয়েছিল। তাদের প্রথমে চেষ্টা ছিল পুরো জাতিকেই শেষ করে দেয়া। সেটা সম্ভব হয়নি, তারপর চেষ্টা চালিয়েছিল দেশের লোকবল কমিয়ে ফেলা। তারপর তারা আঘাত করে দেশের মাথা সম্পদের উপর।
সন ১৯৭১, পুরোটাই বিকল্প পরিকল্পনার পেছনে ছুটেছে মেজর হাবিলদারদের প্রভুরা। শেষমেশ জাতিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা সফল হতে না পেরে চার বছরের ব্যবধানে আঘাত হানল অন্যতম শক্তির আধারে। প্রথমে জাতি এবং পরবর্তীকালে জাতির পিতাকে আঘাত, অথচ পরপর দুটো পরিকল্পনাই ব্যর্থ করে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের ভাগীদার। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ইতিমধ্যে মধ্যম আয়ের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে হয়তো বলা যেত কোথায় গিয়ে ঠেকবে এই অগ্রযাত্রা।
একদা এক মার্কিন মন্ত্রীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে ছিল যেন কেউ বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত না করে, বলা হয়েছিল সাহায্য রাখার জায়গা নেই বাংলাদেশে। ঝুড়ির তলাতে ফুটো। আবার এইতো কিছুদিন আগে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট তারই পূর্বপুরুষের দেশে দাঁড়িয়ে বিশ্ব উন্নয়নের প্রশংসা করতে গিয়ে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করে বসলেন। হয়তো বাংলাদেশের সম্মুখ গতিতে এগিয়ে যাওয়ার পথে আবারো বাধা আসবে। হয়তো আবারো আসবে বিভাজন, অন্ধকার আহ্বান। হয়তো ছোট ছোট মনের ছোট ছোট কাজের প্রভাব পরবে দেশে।
ভরসা এইটুকু যে বাঙালিরা বুঝে গেছে উন্নতি করতে হলে দেশের মানুষকে প্রথমে বাঙালি হতে হবে। বাধা পেলেও মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ের ভেতরে লুকানো। সেই যে বলা হয়েছিল ‘এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। কৃতজ্ঞ জাতি কখনো তার অতীত ভোলে না। বুক শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কণ্ঠে তোলা সেই অমোঘ বাণী ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ আজো বাঙালিদের বাঙালি হয়ে থাকার মূলমন্ত্র। আগামী দিনে বাংলাদেশকে নিয়ে আবারো যারা লাটিম খেলার বাসনা করেন তাদের বলতে ইচ্ছে করে; আপনারা সত্য কে মেনে নেন।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নিজ গোষ্ঠীর অন্যতম মানুষকে যখন এগিয়ে দিয়ে বলে, নেতা তুমি এগিয়ে যাও আমরা আছি তোমার সাথে। তখন আর সেই নেতা স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের মধ্যে অবস্থান করেন না, তিনি হয়ে যান দেশের নেতা দশের নেতা। বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে যে নেতা সকলের কথা বলার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁকে হত্যা করেও পেছনের মানুষগুলোকে থামানো যায় নি। বাস্তবতা হল কোন মানুষই চিরদিন বেঁচে থাকে না আবার কিছু মানুষ আছেন হত্যা করেও তাদের নাম মুছে দেয়া যায় না। এই ক্ষণজন্মা মানুষগুলোর নাম বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে। শুধু লাটিম খেলার দল কিছুদিন চেহারা দেখিয়ে ধুলোয় মিশে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)