মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য। পর্ব-৭ (ডিসেম্বর ৭, ২০১৬)
আমাদের দেশে লাইব্রেরি গড়ার আন্দোলন কখনোই প্রাণ পায়নি। বাংলা মোটর মোড়ের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বই পড়া আর গাড়িভিত্তিক লাইব্রেরিসহ কিছু কর্মকান্ড করলেও প্রয়োজনের তুলনায় সেটি নিতান্তই সামান্য। স্বাধীনতার পরে সরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে সরকারি গণগ্রন্থাগার বর্তমানের উপজেলা আগেকার থানা ও মহকুমা শহর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলেও সেগুলোর বেশিরভাগের অস্তিত্ব এখন কাগজপত্রে সীমিত হয়ে পড়েছে। দেশের কিছু নামকরা স্কুলে একদা জোরালো লাইব্রেরি কার্যক্রম থাকলেও সেগুলোও এখন তেমনভাবে কার্যকর নয়।
লাইব্রেরি একটি সেবা প্রতিষ্ঠান। এটি কোনো আয়মূলক সংগঠন নয়। একটি পাড়া কিংবা এলাকায় যে লাইব্রেরি থাকে সেটি মূলত সেখানকার জনগণের আগ্রহ ও সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে লাইব্রেরির অস্তিত্ব একটি এলাকায় বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। এর বড় প্রমাণ আমাদের দেশের সরকারি গণগ্রন্থাগারগুলোর অকালমৃত্যু।
বাংলাদেশে আশির দশকে দাতা সংস্থার অর্থায়নে গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার নামে দেশে একটি লাইব্রেরি আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন টিকে থাকেনি। আমরা লক্ষ্য করেছি একসময় দেশে স্কুলভিত্তিক লাইব্রেরি আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল সেভ দি চিলড্রেন ইউএসএ তাদের সাকসিড প্রকল্পের মাধ্যমে। শিখন সাথী নামের এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া শিশুরা জ্ঞানের নানান শাখার বই পড়ার মধ্য দিয়ে নিজেদের জ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ পায়। এই ধরনের স্কুলভিত্তিক বই পড়া কার্যক্রম আরো অনেকগুলো সংস্থা বিভিন্ন সময় পরিচালনা করেছে। এমনকি সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকেও ইউনিসেফের সহায়তায় স্কুল ভিত্তিক লাইব্রেরি গড়ে তোলার উদ্যোগ ছিল। তারা শিশুদের উপযোগী বই ছাপিয়ে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বিতরণ করছে। তবে সেই সব উদ্যোগ খুব একটা প্রাণ পায়নি। অনেক স্কুলে হেড স্যারের আলমিরাতে বইগুলো আটকে ছিল। শিক্ষার্থীদের কাছে আর পৌঁছেনি। আসলে এই ধরনের মহৎ উদ্যোগগুলোর টিকে থাকা না থাকা পুরোপুরি নির্ভর করবে শেষ পর্যন্ত ওই স্কুলগুলো এবং স্কুল সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর আগ্রহ ও কর্মতৎপরতার উপর।
একটি কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বই পড়া থেকে যে রিটার্ন পাওয়া যায় তা সাদাচোখে দেখা যায় না। এটি পরিমাপের সরাসরি কোনো সূত্র নেই। যেকারণে এই খাতে কোনো ব্যবসায়ী বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেন না। যেহেতু লাইব্রেরির সুফল শুধু একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ে কিংবা একটি পরিবার বা নির্দিষ্ট একটি সমাজে সীমিত থাকে না। এর সুফল ব্যক্তির জীবনবোধ উন্নত করার মধ্য দিয়ে দেশ ও সমাজে ছড়িয়ে পড়ে তাই এখানে বিনিয়োগে সকলের এগিয়ে আসা দরকার। কারণ এই বিনিয়োগে কোনো লস নেই। তবে এই সময়ে কেউ যদি লাইব্রেরি আন্দোলন করতে চায় সেক্ষেত্রে সেই লাইব্রেরিতে কমপিউটার থাকাটা জরুরি। এমনকি কমপিউটার আর ইন্টারনেট সংযোগ দিতে হবে। কারণ জ্ঞান চর্চায় এখন কমপিউটার আর ইন্টারনেট একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
এদিকে সমাজ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের গবেষণা থেকে জানা যায়, এখন থেকে দশ বা বিশ বছর আগে একটি স্কুলে কিছু ছাত্র-ছাত্রী ছিলো যারা লাইব্রেরিতে যেতে এবং বই পড়তে পছন্দ করতো। এই সংখ্যা বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। আজকালকার শহরের স্কুলগুলোতে ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরিতে গেলেও মফস্বলের ছেলেমেয়েরা লাইব্রেরির বই পড়তে উৎসাহিত হন না। ক্লাসের বইয়ের বাইরে তাদের আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতো বই প্রথমত তারা পান না এবং দ্বিতীয়ত যেসব স্কুলে লাইব্রেরি আছে সেখানকার চাবি থাকে বিদ্যালয়ের কোনো একজন শিক্ষকের কাছে যা চেয়ে নেয়ার সাহস কিংবা উৎসাহ কোনটিই শিক্ষার্থীদের থাকে না।
এদিকে বিশ্বজুড়ে লাইব্রেরিগুলোতে একটি নীরব পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ পাঠক চাহিদার পরিবর্তন। যেকারণে বিশ্বজুড়ে লাইব্রেরি ২.০ নামে নতুন একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে। লাইব্রেরি ২.০ লাইব্রেরি সেবার পুরোনো সব কিছুই বদলে দিয়েছে। লাইব্রেরি ২.০ হলো ব্যবহারকারীর চাহিদা মাফিক লাইব্রেরি সেবা দেয়ার নতুন কনসেপ্ট। তবে অনেকে বলেন লাইব্রেরিগুলোর জন্যে তহবিলের সঙ্কোচনই বর্তমান পরিবর্তনের মূল কারণ। এরপরও যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার সেটি হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি গতানুগতিক লাইব্রেরি ধারণাকে বদলে দিচ্ছে ভীষণভাবে। আমরা যদি দেশে এখন নতুন করে একটি লাইব্রেরি আন্দোলনের কথা ভাবি তবে আমাদেরকে ইন্টারনেটের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এখনকার লাইব্রেরিতে শুধু বই থাকলেই হবে না। সেখানে ভালো মুভিও থাকতে হবে। আসলে একটি লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চার সবধরনের সুযোগ থাকা উচিৎ। যদি রাখা সম্ভব হয়।
একটি উপজেলার কথা চিন্তা করা যাক। সেখানে কি একটি লাইব্রেরি থাকবে? নাকি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রামে একটি করে লাইব্রেরি থাকবে? এই বিষয়টি ওই এলাকার জনগণই ঠিক করবেন। আবার প্রশ্ন উঠতে পারে প্রতিটি লাইব্রেরিতেই কি সবকিছু থাকবে? এর উত্তর হলো না। প্রতিটি লাইব্রেরিতে সব কিছু রাখার দরকার নেই। তাতে অনেক বেশি সম্পদের দরকার হবে। যার যোগান দেয়া এলাকাবাসীর পক্ষে সম্ভব হবে না। বরং একটি উপজেলায় যদি দশটি লাইব্রেরি থাকে তবে তারা নিজেদের মধ্যে বই, ভিডিও, তথ্যচিত্র ইত্যাদি দেয়া-নেয়া করতে পারে। ফলে সকল লাইব্রেরিতে একই বই কিংবা ভিডিও কেনার জন্যে বিনিয়োগ করার দরকার হবে না। বরং লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্কিং গড়ার মাধ্যমে আমরা যেমন সম্পদের অপচয় রোধ করতে পারবো তেমনি এলাকাবাসীর মধ্যে একটি সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবো।
আমাদের মনে রাখতে হবে, লাইব্রেরিগুলোর সীমাবদ্ধতা সবসময়ই ছিলো। একটি এলাকার সকল মানুষের চাহিদা কখনোই একটি লাইব্রেরির পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ একটি লাইব্রেরির জায়গা ও অর্থের সীমাবদ্ধতা ছিলো। এটি কখনোই কাটিয়ে উঠাও পুরোপুরি সম্ভব হবে না। তাই একটি লাইব্রেরির পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকা দরকার তার এলাকার বেশিরভাগ মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাদের মধ্যে নতুন চাহিদা তৈরি করা যা পূরণে ওই লাইব্রেরি সক্ষম। যারা লাইব্রেরি ব্যবহারে আসেন তাদের কাছ থেকে তাদের চাহিদা জেনে নেয়া সহজ কিন্তু যারা লাইব্রেরি ব্যবহারে আসেন না তাদেরকে যদি নিয়ে আসা না যায় তবে সমাজ উন্নয়নে লাইব্রেরির যে ভূমিকা সেটি পূরণ হওয়ার নয়।
অনেকে বলেন লাইব্রেরি নাকি এখন বাড়িতে বাড়িতে পৌছে গেছে। তারা মিথ্যা বলেন না। একটি ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে লাইব্রেরির বেশিরভাগ সেবা বাসায় বসেই পাওয়া যায়। যেমন: উইকিপিডিয়া হাজারো প্রশ্নের সমাধান দিচ্ছে। কিংবা কোনো জটিল কিছু জানার দরকার হলে মাইস্পেস, ফেসবুক ইত্যাদি ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্কভিত্তিক ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়ে দ্রুতই অনেক দরকারি কিছু জানা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি লাইব্রেরি তৈরি করা ও এর ব্যবহার কোনো একটি পাড়া ও মহল্লায় নিশ্চিত করা গেলে অনেক ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। ঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হলে লাইব্রেরি হয়ে উঠতে পারে আমাদের দেশের আগামীদিনের গণতন্ত্র চর্চার সবচেয়ে উত্তম জায়গা। যে দেশগুলোতে গণতন্ত্র আছে সেখানকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বই পড়ার চর্চাও আছে। যেমন ধরুন ভারতে। ভারতের মানুষ খুব ট্রেনে চড়ে, সেখানে আপনি দেখবেন ট্রেন যাত্রী সব বয়সীরাই বই পড়ছে। এই চিত্র আপনি ইউরোপ ও আমেরিকাতেও দেখতে পাবেন। এই চিত্র খুব দেখবেন বাংলাদেশে। তারপরও আমি ঢাকার বাসযাত্রীদের জ্যামে বসে বই পড়তে দেখি। ইন্টারসিটি ট্রেনের যাত্রীদের বই পড়তে দেখি। লঞ্চ যাত্রীদের বই পড়তে দেখি। তারমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুরোপুরি মরেনি। টিম টিম করে জ্বলছে। আমরা যদি ভরা পূর্ণিমার আলো ছড়ানো গণতন্ত্র দেখতে চাই তাহলে আমাদের দেশে অবশ্যই বই পড়ার চর্চা বাড়াতে হবে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তির শপথ হোক পাড়ায় মহল্লায় আধুনিক ও সময়োপযোগী লাইব্রেরি গড়ে তোলা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)