বুধবারের সন্ধ্যাবেলা। অক্টোবরের ১৮ তারিখ, সাল ২০১৭। মহাখালী থেকে উত্তরের রাজপথ, ঝিমধরে আটকে আছে। কেউ সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না অচল হয়ে যাওয়া পথ কখন সচল হবে! দিন শেষে যারা ঘরে ফিরবে এই শহরের, কিংবা যাবে আরো দূরে অন্যকোনো শহরে বা গ্রামে তারা অসহায়! উপায়-বুদ্ধি না পেয়ে অনেকে হাঁটতে শুরু করে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। সেই হাঁটার দলে, হাঁটার মিছিলে নিজেকেও সামিল করে নিতে হয় অগত্যা।
কেনো এমন? বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিন মাস পর যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরবেন। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রাজপথে তাকে নেতাকর্মীরা অভ্যর্থনা জানাবেন এটাই স্বাভাবিক। এখনো এই হা-রাজনীতির দেশে; রাজনীতিবিদরা ভরসার স্থল সাধারণ মানুষের কাছে। আর চরিত্রটি যদি হন খালেদা জিয়া তাহলে বলার অপেক্ষাই রাখে না তাকে দেখার জন্য এবং তাকে দেখানোর জন্য রাজপথে নেতাকর্মী এবং ভাসমান মানুষের ভীড় জমবেই। প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ বিএনপিকে যতই রাজনৈতিক শত্রু ভাবুক, প্রতিপক্ষ বলে দমন করতে চাক, যতই বলা হোক ‘বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলই না’ দৃশ্যমান সত্য হলো; বিএনপি এখনো বড় ‘ভোটের দল’। বিএনপির অন্যকোনো নেতা না বুঝলেও এটা খুব ভালো করে বোঝেন খালেদা জিয়া, আর বোঝেন দুর্নীতির দায় নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান। মানুষকে নিয়ে সেই রাজনীতিটাই করছেন তারা। তাই খালেদা জিয়া যে কারণেই হোক বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে তাকে ঘিরে রাজপথে জনতার মিছিল নামবে, পথ-ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে, দীর্ঘ-দীর্ঘতর যানজট হবে, পথে পথে মানুষের কষ্ট হবে এটা এখন এক ধরনের সত্য হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকে ফিরলেও মাঝে মাঝে এমনটি ঘটে। জনগণের কষ্ট হবে ভেবে এসবে প্রধানমন্ত্রী নিমরাজি থাকলেও দলের কথা মেনে নিতে হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল, জনগণ আছে দল দু’টোর; তাই বলে সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের দেশে ফেরায়ও অভ্যর্থনার নামে অচল হবে রাজপথ? কদিন আগে এটাও হয়েছে।
দুই.
আমি ভরসা রেখেই বলি, এই শহরে গাড়ির চেয়ে আমার পায়ের গতি বেশি! আচ্ছা কেউ কি বলতে পারবে ঢাকা শহরের গতি কত? ছুটির দিনগুলো আর শেষ রাতের কথা বাদে; উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, ঢাকা শহর পুরোটাইতো ‘জ্যামের নগরী’ হয়ে থাকে। ঘর থেকে বেরুলে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না কখন পৌঁছবে গন্তব্যে। ঘর থেকে বের হলে সময়মতো আর ঘরে ফিরতে পারবে কী না এটাও জানে না কেউ! এমন অনিশ্চয়তার শহরে জনগণের দলের নেতারা যখন বিদেশফেরত হন, তখন তাদের অভ্যর্থনার নামে রাজপথে-শহরজুড়ে নেমে আসে দুর্যোগ! দফায় দফায় মনুষ্যসৃষ্ট এ দুর্যোগ থেকে সহসাই আমাদের নির্বাণ লাভ হবে এমনটি আশা করা যাচ্ছে না।
তা হলে? ওই যে, মানুষ হাঁটছে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে। সন্ধ্যা শেষে নেমেছে রাত; মানুষ হাঁটছে। ফুটপাতে মানুষের মিছিল, কেউ জানে না এই মিছিল কোথায় গিয়ে শেষ হবে! মহাখালী থেকে বনানী-কাকলী। অফিস ফেরত কেরানী, বিশ্বাবিদ্যালয় ফেরত তরুণী, নরসিংদীগামী পৌঢ় হাঁটতে হাঁটতে ভাবে; হয়তো একটু পরেই সচল হবে পথ। না, হয় না। মানুষের হাঁটার মিছিল এগোয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছুঁয়ে শাওড়া, বিশ্বরোড, খিলক্ষেত। তারপর দুদিকে এক বিরাণ প্রান্তর, কাউলা-এয়ারপোর্ট সেতো অনেক দূর! রাজপথ অনড়, কেবল কিছু মোটরসাইকেল ট্রাকের চেয়ে উচ্চমাত্রার হর্নে জানান দেয় বিপুল তাড়া তাদের। কোথাও প্রলয় ঘটে যাচ্ছে, সব টেলেঠুলে পৌঁছতেই হবে গন্তব্যে!
খালেদা জিয়াকে বহণকারী উড়োজাহাজটি ঢাকার বন্দরে নামার পূর্ব অনুমান সময় ছিলো বিকাল সাড়ে পাঁচটা। প্রায় ২০ মিনিট আগেই চলে আসে সেটি। তারও অনেক আগ থেকে বিমানবন্দর এবং রাজপথে অবস্থান নেয় বিএনপি নেতা-কর্মী-সমর্থক আর উচ্ছুক মানুষ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া কাউকে ভিআইপি লাউঞ্জে ঢুকতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাই সকলের অবস্থান বাইরে। তাই বলে তাদের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। অনেকে নানা রঙের-নানা মাপের ব্যানার নিয়ে এসেছেন তাদের নেতাকে অভিনন্দিত করতে। দু-একটিতে এটাও দেখা গেলো খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্র্যাসি’ বলা হচ্ছে। ‘গণতন্ত্রের মা বা জননী’। বিষয়টা মন্দ না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেউ কেউ ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলে অভিহিত করেন; কেনো জানি না। এখন খালেদা জিয়াকে কি গণতন্ত্রের মা বলে ডাকবে তার দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা? এসব দেখছি, ভাবছি আর হাঁটছি। মানুষ হাঁটছে আর গল্প বলছে। অনেক গল্প। নাম পরিচয় কিছু জানি না, এক হাঁটাবন্ধু, পোড় খাওয়া চেহারা, হঠাৎ করেই বলে উঠেন-‘এমন একটি দলকে রাস্তায় নামতে দেয় না সরকার; এটা হলো?’
তিন.
ওই মানুষটার প্রশ্ন অনুরণন সৃষ্টি করে আমার ভেতর। সত্যিই তো; এতো জনপ্রিয়, এতো জনসমর্থিত একটি দলকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে দেয়া হবে না কেনো? গণতন্ত্র থাকলে অনেক মত আর পথ থাকবে এটাইতো স্বাভাবিক, নাকি? আওয়ামী লীগ নেতাদের একজন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার রাজনৈতিক সততা, নিষ্ঠা সকলের জন্য অনুকরণীয়, শিক্ষনীয় হতে পারে। তিনি তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর দেশে তখন সেনানিয়ন্ত্রিত অদ্ভুত এক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন। আমরা পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টাররা গোয়েন্দার মতো অনুসরণ করি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে। তিনি সব সময় কথা বলেন না, মাঝে মাঝে যা বলেন তা ফলে এবং তাৎপর্যবহ। তো সেই ঘোর বিপদের দিনে তিনি গণতন্ত্রের গুরুত্বের কথা বললেন, এবং এটাও বললেন, ‘গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভিন্নমত থাকতে হবে, এটাই বিউটি।’
তো খালেদা জিয়ার এ দফা বিদেশফেরত দৃশ্যে আমরা মানুষের ভয়-শঙ্কা আর উচ্ছ্বাসের ভেতর সেই ‘বিউটি’ দেখতে পেয়েছি। আর হাঁটার গল্প? হাঁটা ভুলে যাওয়া ঢাকা শহরবাসীর জন্য এমন দুর্ভোগ নেমে আসবেই কখনো রাজনীতির নামে কখনো বা দু’ পর্বের ইজতেমার সময়ে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)