১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। অভ্যুত্থানের পর সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানকে পদ থেকে সরিয়ে গৃহবন্দী করা হয়। তবে অভ্যুত্থান পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গভবনে ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হয়।
খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান মাত্র তিনদিন স্থায়ী হয়। কর্নেল তাহেরে নেতৃত্বে জাসদ অনুগত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সেই পাল্টা অভ্যুত্থানেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হাতে নিহত হন সেনা প্রধান খালেদ মোশাররফ।
ইতিহাসবিদদের বিশ্লেষণে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার কয়েকটি কারণের অন্যতম কারণ মনে করা হয় খালেদ মোশাররফকে “ভারতপন্থী” হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধীপক্ষের ব্যাপক প্রচার চালানো।
রাজনীতি বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ তার “জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়’ বইয়ে লিখেছেন: অভ্যুত্থানের পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ উদ্যোগে একটি শোক মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসায় যায়। সেই মিছিলে খালেদ মোশাররফের ভাই আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ এবং তার মা অংশ নিয়েছিলেন। শহরে রটে যায় ‘আওয়ামী লীগ-বাকশালীদের’ পক্ষে অভ্যুত্থান হয়েছে।
‘ইনসাইড র’ গ্রন্থে অশোকা রায়না লিখেছেন- খালেদ মোশাররফ ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার একটি কারণ হতে পারে, ‘র’-এর পাকিস্তান শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এস শংকর নায়ারের (যিনি কর্নেল মেনন ছদ্মনাম নিয়ে চলতেন) সঙ্গে মোশাররফের একাত্তরের যুদ্ধকালীন যোগাযোগ।
এই বই থেকে আরও জানা যায়, সেই সময় শংকর নায়ার বাংলাদেশ সীমান্তজুড়ে অবিরাম যোগাযোগের জন্য অনেক ‘নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র’ খোলেন। ‘ইনসাইড র’ বইয়ে খালেদ মোশাররফকে শংকর নায়ারের একজন ‘কেন্দ্রপ্রধান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন অশোক রায়না।
‘পূর্বোক্ত’ গ্রন্থে আনোয়ার উল আলম লিখেছেন, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ভারতে পালিয়ে যাবেন, তা-ও নির্ধারিত ছিল।
৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান ‘ভারতপন্থী’ ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টা হিসেবে চিত্রিত হওয়ার অন্তত আরও একটি সুনির্দিষ্ট কারণ ঘটিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন।
ওই অভ্যুত্থান-পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বঙ্গভবনে ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তন যজ্ঞে, বিশেষ করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান হওয়া এবং বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করার প্রক্রিয়ায় সমর সেন সক্রিয় ছিলেন সেখানে।
সমর সেনের বঙ্গভবনে অবস্থান এবং অক্টোবরে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের রাজনৈতিক উদ্যোগ স্পষ্টত সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই জনমনে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানকারীদের ‘ভারতপন্থী’ হয়ে পড়ার ‘গুজব’ কিছুটা হলেও বাস্তব ভিত্তি তৈরি করেছিল।