সৌন্দর্য বর্ধনের নামে অপরিকল্পিতভাবে নিম্নমানের ভাস্কর্য তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো আবার উস্কে দিচ্ছে বিতর্ক, অপচয় হচ্ছে বিপুল অর্থ। এজন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনার অভাব এবং সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করেছেন শিল্পকর্ম বিশেষজ্ঞরা।
তবে কোথায় কোন ভাস্কর্য থাকবে বা থাকবে না সেটা ঠিক করার এখতিয়ার ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠীর নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তারা। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এবিষয়ে নজর দিয়েছেন তাই অবিলম্বে নগরবিদ, স্থপতি, শিল্পী-ভাস্কর, বুদ্ধিজীবী সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করার দাবি তাদের।
সুুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে স্থাপিত ভাস্কর্যের মান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের সঙ্গে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,“এই ভাস্কর্যের পরিকল্পনাটা অত্যন্ত নিম্ন রুচির বলে মনে হয়েছে আমার। সারা পৃথিবীর আদালতে পরিচিত একটি অবয়ব এটি। সেটিকে কেউ চাইলেই শাড়ি পরিয়ে বাঙালি করে দিতে পারে না। শাড়িও পরানো যেতো যদি সেখানে বেগম রোকেয়া বা আইনক্ষেত্রে আমাদের আইকনিক কোনো নারী থাকতো। কিংবা বিশ্বব্যাপী যে প্রতীকী ভাস্কর্যটি আছে তা হুবহু তৈরি করা যেতো। গ্রিক কোনো কিছু এদেশে অনুসরণ করা যাবে না এমন তো নয়। মেডিকেলের প্রতীক হিসেবে প্রাচীণ গ্রিসের সর্প চিহ্ন ব্যবহার হয়ে আসছে। এখানে ভাস্কর্য বিকৃত করার তো কিছু নয়। রুচির দিক দিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে আমি এই ভাস্কর্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করি।”
কিন্তু এব্যাপারে কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চাপের কাছে মাথা নত করার বিষয়ে প্রবল আপত্তি তার। বরং এসব ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তরে ধারণ করা এবং দেশের শিল্প-সংস্কৃতির চর্চাকারীদের মতামত নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক নিসার বলেন,‘আজকে সেখানে ভাস্কর্য থাকবে কি থাকবে না এই কথাটা আমরা প্রথম শুনতে চাই যারা দেশ স্বাধীন করেছেন সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। যারা এই দেশ চায়নি, যারা এইদেশের আদর্শের সঙ্গে একমত নয় তাদের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী কেনো ভাস্কর্য সরাতে চান? প্রধানমন্ত্রীর জন্য তো তারা এইদেশে রাজনীতি করে না। প্রধানমন্ত্রীর পিতা যে আদর্শে রাজনীতি করেছেন, যার কাছ থেকে আমরা এই দেশ পেয়েছি তাঁকে তো এরা ধারণ করেনা। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিক যে কোথায় ভাস্কর্য থাকবে না থাকবে তা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।’
আলোচিত ভাস্কর্যটির মান প্রশ্নে ডিনের সঙ্গে পুরোপুরি একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারপার্সন এ এ এম মো. কাওসার হোসেন।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন,‘সামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নিজস্বতা আছে। একটি ভাস্কর্যের টিকে থাকাটাও তো মনে রাখতে হবে। একজন ভাস্কর তো চাইবেন যে তার কাজটি যেনো গ্রিক সভ্যতা, রোমান সভ্যতার ভাস্কর্যগুলোর মতো শত শত বছর টিকে থাকে। আমি ভাস্কর্য নিয়ে পড়েছি, পড়াচ্ছি। যেটা জানি তা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মকে জড়িয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। ইন্দোনেশিয়া মুসলিম দেশ সেখানেও কিন্তু মসজিদের প্রবেশ পথেই একটি শিল্পকর্ম রয়েছে।’
মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে যাতে কোনো ভাস্কর্য অপসারণ করা না যায় সেজন্য আগে একটি সমন্বিত কমিটি গঠনের বিষয়ে জোর দেন তিনি। এতে করে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ কাজটি চূড়ান্ত রূপ পাবে বলে মনে করেন ভাস্কর্য বিভাগের এই শিক্ষক।
তার মতে, কোথায় কোন ভাস্কর্য হবে তা সংশ্লিষ্ট জায়গার কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করে দেবে। ভাস্কর সেই চাহিদাটা শিল্পগুণসমৃদ্ধ একটি ভাস্কর্য বানিয়ে পূরণ করবে। এদেশের মুসলিমরা উগ্রপন্থী-কট্টর নয় বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
মঙ্গলবার রাতে গণভবনে ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারী ওলামাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটি সরাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
ভাস্কর্যটির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন: আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। বলা হচ্ছে এটা নাকি গ্রিক মূর্তি। আমাদের এখানে গ্রিক মূর্তি আসবে কেন? আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিৎ না। গ্রিকদের পোশাক ছিল এক রকম। এখানে আবার দেখি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। এটাও হাস্যকর হয়েছে।