রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় নানা অব্যবস্থাপণা ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মুখে এক জরুরি বৈঠকে বসে সে পরীক্ষা বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত হবে পরবর্তী সময়ে কী প্রক্রিয়ায় এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ এসব সিদ্ধান্তে ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আট ব্যাংকের ১ হাজার ৬৬৩টি পদে নিয়োগের একটি পরীক্ষার আপাত সমাধান হলো বটে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া আইনি যে জটিলতায় আটকে আছে তার কোন সমাধান না করলে প্রকৃত সমাধান কি হবে?
সোনালী, রূপালী এবং জনতা ব্যাংকের নিয়োগ নিয়ে যে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহসা সমাধান হবে বলে মনে হয় না।চাকরিপ্রার্থীদের এক রিটের কারণে আটকে আছে এই তিন ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, সাধারণ অফিসার এবং ক্যাশ অফিসারের ছয়টি বিজ্ঞপ্তির নিয়োগ প্রক্রিয়া। রিটকারীরা বলছেন এ সমস্যার সমাধান না হলে তারা বারবার আদালতে যাবেন।আর এ তিনটি ব্যাংকের এ জটিলতার কারণে প্রভাব পড়বে সবগুলো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে।
২০১৩ ও ২০১৪ সালে সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের প্যানেল নিয়োগ প্রত্যাশীদের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে এই তিন ব্যাংকের ছয়টি পরীক্ষার ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় আলাদা করে এই তিন ব্যাংকের পরীক্ষা নিতে পারছে না ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি। তাই তারা কৌশল হিসেবে সমন্বিতভাবে আরও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই তিনটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় ২০১৭ সালের আগস্টে। কিন্তু ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তির পরীক্ষা না নিয়ে ২০১৭ সালের বিজ্ঞপ্তির পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হলে আদালতে যান ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদন করা ২৮ জন চাকরিপ্রার্থী।
এই রিটের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে রিটকারীদের আইনজীবী রাশেদুল হক খোকন সাংবাদিকদের বলেন, ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে রিট আবেদনকারীরা ওই তিন ব্যাংকের বিভিন্ন পদের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো কোনো পরীক্ষা নেয়নি। তবে ২০১৭ সালে নতুন করে একই পদের জন্য গত বছরের ২৩ ও ২৯ আগস্ট এবং ৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর ভিত্তিতে ১২ জানুয়ারি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পদে এমসিকিউ পরীক্ষার দিন নির্ধারণ হয়েছে। এটি বৈষম্যমূলক বলে রিটটি করা হয়। রুলে ওই তিন ব্যাংকের বিভিন্ন পদে নিয়োগসংক্রান্ত ২০১৭ সালের ওই বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ২০১৭ সালের বিজ্ঞপ্তির আলোকে পরীক্ষার আগে কেন ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের পরীক্ষা না নেওয়ার পেছনেও রয়েছে আইনী জটিলতা। কারণ, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোর নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) গঠনের আগেই ২০১৩ ও ২০১৪ সালে সোনালী, রূপালী ও জনতা ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি ছিল। এরমধ্যে কিছু পদের জন্য পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত এবং অপেক্ষমান তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছিল। কিন্তু বিএসসি গঠনের পর নিয়োগের ভার চলে যায় ওই প্রতিষ্ঠানের হাতে। এরপর সংশ্লিষ্ট তিন ব্যাংক বিএসসির কাছে আবেদন করে, আগের প্যানেল থেকে প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়ে শূন্য পদগুলো পুরণের জন্য। কিন্তু পরীক্ষা ও প্যানেল প্রস্তুতের কোন পর্যায়েই তাদের যুক্ততা ছিল না বলে আগের প্যানেল থেকে নিয়োগ দিতে আগ্রহ দেখায় না বিএসসি।
তিনটি ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি বিএসসির তৎকালীন সদস্যসচিব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক লায়লা বিলকিস আরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদা বরবার একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘‘যেহেতু সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের আবেদন সমূহ কোন চলমান/অসমাপ্ত কাজের বিষয় নয় এবং ব্যাংকগুলোর অপেক্ষমান তালিকা প্রণীত হয়েছে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি গঠনের পূর্বে প্রস্তুতকৃত প্যানেল হতে (যে প্যানেল প্রস্তুতের কোন পর্যায়েই ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কোন সম্পৃক্ততা ছিল না); সেহেতু ব্যাংকগুলোর আবেদনে উল্লেখিত নিয়োগ সংক্রান্ত কাজ অসমাপ্ত কাজ বিবেচেনায় সুপারিশ প্রদানের সুযোগ অত্র কমিটির নেই।’’
‘‘এমতাবস্থায়, সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের অপেক্ষমান তালিকা হতে লোকবল নিয়োগ বিষয়ে এ কমিটির (বিএসসি) দিক থেকে কোনরূপ ভুমিকা নেওয়ার অবকাশ লক্ষ্যনীয় নয়।’’
এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আগে প্রস্ততকৃত প্যানেল বাতিল করে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশনা দেয় অর্থ-মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব মো. রিজওয়ানুল হুদা স্বাক্ষরিত ব্যাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট তিনি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহিদের বরাবর পাঠানে চিঠিতে বলা হয়: ‘‘পত্রসমুহের (তিন ব্যাংকের) বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিম্মরূপ মন্তব্য করেন: যেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থী আছে তাদের কাউকেউ এখন নিযুক্তি দেওয়া যাবে না, আগের পরীক্ষার প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। দ্রুত গতিতে নতুন পরীক্ষা নেওয়া উচিত। পরীক্ষার তারিখ, ফলাফল ঘোষণার তারিখ এবং সেই সহ নতুন নিযুক্তির তারিখ সম্বন্ধে জানতে চাই। এই তারিখ ঘোষণার সময় কত পদ পুরণ করা হবে ঘোষণা করা সম্বন্ধে সুপারিশ চাই।’’
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসসিকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ হতে।
এই নির্দেশনার পর নতুন করে নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ থেকে ৩ আগস্টের মধ্যে এই তিন ব্যাংকের ছয়টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় বিএসসি। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের ৭০১টি, সাধারণ অফিসারের ৮২০টি এবং ক্যাশ অফিসারের ৭৫৫টি পদে, ১০ মার্চ জনতা ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক্সিকিউটিভ অফিসারের ৪৬৪টি পদে, ২৬ জুলাই রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের ৪২৩টি পদে, ৩ আগস্ট সাধারণ অফিসারের ৭৩৬টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু এসব বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আদালতে যায় ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বিজ্ঞপ্তির চূড়ান্ত প্যানেল থাকা চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে সোনালী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের নতুন করে বিজ্ঞাপিত সবগুলোর পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। যার ফলে ওই ছয় বিজ্ঞাপনের একটি পদেও এখন পরীক্ষা হয়নি।
ওই পদগুলোর পরীক্ষা না নিয়েই নতুন করে সমন্বিতভাবে আরও পাঁচ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সোনালী, রূপালী এবং জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসারের পদগুলো যোগ করে ২০১৭ সালের আগস্টে নতুন করে বিজ্ঞাপণ দেয় বিএসসি। গত ১২ জানুয়ারি এ পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হলে আদালতে যায় ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করা ২৮ জন শিক্ষার্থী। তাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী, রূপালী এবং জনতা ব্যাংকের পদগুলোতে নিয়োগে আবারও স্থগিতাদেশ দেয় হাইকোর্ট। ফলে ১২ তারিখের পরীক্ষা নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। পরবর্তীতে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় ছয় সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিলে সমন্বিত পরীক্ষার আইনি বাধা আপাতত কেটে যায়। এরপর ৮ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৬৬৩টি পদের জন্য গত ১২ জানুয়ারি ঢাকার ৬১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা হয়। কিন্তু পরীক্ষায় নানা অনিয়ম ও অব্যস্থাপণার অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করে চাকরিপ্রার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি সভা করে মঙ্গলবার ওই পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিটকারীরা বলছেন, ২০১৩ ও ২০১৪ সাল যারা পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তির্ণ হয়ে প্যানেল ছিলেন তাদের বেশিরভাগের বয়সই শেষ হয়ে গেছে। তাদের নতুন করে অন্য চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ নেই। এমনকি ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের সমন্বিত বিজ্ঞপ্তিতেও তাদের অনেকে আবেদন করতে পারেননি বয়স না থাকার কারণে। এমতাবস্থায় তাদের আদালত ছাড়া যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। একই কথা বলছেন ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকারীরাও। তাদের অনেকেও সর্বশেষ সমন্বিত বিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করতে পারেননি বয়স না থাকার কারণে। তারাই সর্বশেষ রিট করে তিন ব্যাংকের নিয়োগে পুনরায় স্থগিতাদেশ নিয়েছেন হাইকোর্ট থেকে।
সুতরাং ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বিজ্ঞপ্তি এবং প্যানেল গঠন নিয়ে সোনালী, রূপালী এবং জনতা ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান না হলে পরবর্তীতে এই তিন ব্যাংকে যতগুলো বিজ্ঞপ্তি আসবে সবগুলোই ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে ওই একই কারণে দুটি বিজ্ঞপ্তি ঝুলে গেছে। আর এতে করে বারবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পরীক্ষা নিলেও যদি তা পরবর্তীতে স্থগিত হয়ে যায় তবে রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় এবং চাকরিপ্রার্থীদের ভোগান্তি ছাড়া আর কোন ফল হবে না।
সুতরাং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জনবল সংকট দূর করতে এবং নিয়োগ জটিলতা দূর করে লাখ লাখ চাকরিপ্রার্থী এবং তাদের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে নজর দিতে হবে সমস্যার গোড়ায়। পৌঁছতে হবে সব পক্ষের কাছে গ্রহনযোগ্য একটি সমাধানে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)