সবাই ঝা চকচকে পোশাকে। বেগম জিয়া নিজেও। কোলাকুলি আর হাসিমুখে আনন্দময় একটা পরিবেশ। বিএনপির আনন্দ একটু বেশি, কারণ সদ্য কারামুক্ত জামায়াত-শিবির নেতারাও সেখানে এসেছেন। অথচ সেই আনন্দময় পরিবেশেও বেগম জিয়া বললেন, এবার কেউ শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালন করতে পারেনি!
ঈদের দিন জমকালো আয়োজনে খালেদা জিয়া এই কথাগুলো বলেছেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সন্মেলন কেন্দ্রে। সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সনের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বাধা দেয়নি, এটা তার প্রমাণ। অবশ্য বিএনপির পক্ষ থেকেও ‘সরকার ঈদে অশান্তি সৃষ্টি করছে’ বলেও কোন অভিযোগ ছিল না। তবে হঠাৎ কেন বেগম জিয়ার মনে হলো ‘এবার দেশে কেউ শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালন করতে পারেনি?’
বিএনপি চেয়ারপার্সনের এমন গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সাধারণ মানুষের ঈদ উদযাপনের একটা স্বাভাবিক চিত্রের দিকে নজর দেয়া যাক। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাব মতে, সারাদেশের প্রায় ২৫ লাখ দোকানে (মুদি দোকান থেকে কাপড়ের দোকান) গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছে।
এছাড়া ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের অনুমানের ভিত্তিতে করা এক তথ্যে জানা গেছে, ঈদ উৎসবে পোশাকসহ যাবতীয় পরিধেয় খাতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা, জুতা-কসমেটিক্সে ৩ হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাতে ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্যে ৭ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ডে ৫ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিক্স পণ্যে ৪ হাজার কোটি, ভ্রমণে সাড়ে ৫ হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় ১ হাজার কোটি ও পবিত্র ওমরা পালনে ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। এ ছাড়া ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন শিল্পে বড় ধরনের কেনাকাটা হয়। এবারের ঈদে যে এই স্বাভাবিক চিত্রের কোন ব্যতিক্রম হয়েছে এমন কোন পরিসংখ্যান কিন্তু বেগম জিয়া তার বক্তব্যে দিতে পারেননি।
বিএনপি চেয়ারপার্সন তার বক্তব্যে এবারের বাজেটকে সবচেয়ে খারাপ বাজেট বলেও আখ্যায়িত করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি হয়তোবা বুঝাতে চেয়েছেন যে, এই খারাপ বাজেটের প্রভাবে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালন করতে পারেনি। কিন্তু এবারের ঈদে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হাওর ও রাঙামাটি ছাড়া রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামে ঈদের কেনাকাটা জমজমাট অবস্থায় ছিল। এটা স্বীকার করতে হবে যে, বাজারে হয়তো অনেক কিছুর মূল্য উর্ধ্বমুখী ছিল, তবে বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এই ক্রয়মূল্যের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে।
এছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে প্রায় প্রতি ঈদে গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের বেতন বোনাস না পাওয়া নিয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে। বেতন বোনাস না পেয়ে শ্রমিকদের জন্য ঈদ হতো অশ্রু আর বেদনার। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো এবারও বিজিএমইএ জানিয়েছে, তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব কারখানার শ্রমিকদের মে মাসের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। এছাড়া ঈদের প্রায় সপ্তাহখানেক আগে ৯৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের চলতি মাসের বেতন পরিশোধ করেছে বলেও জানান বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। বাকি ২ শতাংশ কারখানাও গত শনিবারের মধ্যে জুন মাসের বেতন পরিশোধ করেছে। তাই এবার ঈদে গার্মেন্টস সেক্টরে আনন্দের বদলে বেতন-বোনাসের জন্য কোন আন্দোলন কিংবা বিজিএমইএ ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেখা যায়নি।
এ বছর ঈদের আগে পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয় চলছিল পার্বত্য জেলাগুলোতে। কিন্তু সেই বিপর্যস্ত জনপদের আশ্রয়কেন্দ্রেও ছিল ঈদের আমেজ। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সরকার সেখানে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষদের মুখেও হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছে। তাদের জন্য ছিল ঈদের পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছু। এমনকি পাহাড়ি-বাঙালি কেউ ঈদ উপলক্ষে প্রশাসন ও বেসরকারি সংস্থার বিশেষ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়নি বলেও চ্যানেল আই অনলাইনের বিশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে। কিন্তু ঈদে পাহাড় কিংবা হাওরের দুর্গত মানুষদের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে কোন কিছু ছিল না।
এত কিছুর পরও কি আমরা বলবো এবার সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ পালন করতে পারেনি? রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর থেকে নাড়ীর টানে কোটি কোটি কর্মব্যস্ত মানুষ গ্রামের বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করার পরও আমরা কীভাবে বেগম জিয়ার এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হই? এখানে কি তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার সুযোগ আছে?
এখানে মূল কথা হচ্ছে তিনি ক্ষমতার বাইরে আছেন বলে তার মনে শান্তি নেই। তার নিজের মনের জ্বালা থেকে তিনি ভাবেন সারাদেশেই মানুষের মনে অশান্তি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)